ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়: স্বাভাবিক আচরণ বলে, বড় কোনও দুর্যোগ এলে বাদাবনে উঁচু জমির দিকে চলে যাও। প্রাণ রক্ষা তো হবেই, ডোরা কাটা হলদে গায়ে একটা আঁচড়ও লাগবে না। আজ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য বলছে, হয়েছেও তাই। এ যেন দক্ষিণ রায়ের অমোঘ বাণী। যা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে পুরোপুরি সুরক্ষিত আছে শার্দূল কুল। সুরক্ষিত তো বটেই, হালেই নাইলনের ফেন্সিং নতুন করে বাঁধতে গিয়ে বনকর্মীদের নজরেও পড়েছে একটি। বনদপ্তর সূত্রে খবর, নদীতে নামতে যাবে এমন সময় দূর থেকেই সে নজরে পড়ে যায়। লোকজন দেখে তাদের আওয়াজে আর সে পা বাড়ায়নি। ফের চলে যায় গভীরে।
সুন্দরবনে সদ্য সংখ্যায় বেড়েছে বাঘ আর বাঘিনী। সংখ্যার বিচারে বাঘিনীই বেশি। আমফান ঝড়ের আগে বাঘ ঢোকার একটা বাড়তি ভয় ছিলই সুন্দরবনের গ্রামে। রাতে ঝড় যখন থামল তখনই জানা যায় নাইলনের লম্বা পোক্ত ফেন্সিংয়ের প্রায় ১৬০ কিলোমিটার অংশ ছিড়ে ফর্দাফাই। ভয় দ্বিগুণ হয়ে যায়। রাতে গ্রামে ঢুকতে বাঘের তো সত্যিই আর কোনও বাধা রইল না। এইবার! পরেরদিন সকাল হতেই বনকর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হয় দ্রুত ছেড়া ফেন্সিং নতুন করে লাগাতে। তখনই নজরে আসে আরেকটা বিষয়। জঙ্গল লাগোয়া গ্রামের ক্ষতি সেভাবে না হলেও জঙ্গল থেকে দূরে এলাকার ক্ষতি হয়েছে প্রচুর। নোনাজল প্রায় সর্বত্র ঢুকে গিয়েছে। চাষের জমি নষ্ট। কোথাও ফাঁকা জায়গায় গাছ চাপা পড়ে ভেঙেছে বাড়ি। সেই পরিস্থিতিতে কোনও দিকে না তাকিয়ে আগে গিয়ে ফেন্সিংয়ের ব্যবস্থা করা হয় জঙ্গলের ধার ঘেঁষে। সাবধানের মার নেই। তার পর বাঘ বা অন্য বন্য প্রাণীর খোঁজ শুরু হয়।
দপ্তরের নিজস্ব পদ্ধতিতে খবর নিয়ে জানা যায়, গ্রামের পথে বাঘ যায়নি। সম্ভবত সে আশ্রয় নিয়েছিল জঙ্গলের গভীরে উঁচু কোনও জায়গায়। “এমনটাই হয়।”— বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ সংস্থা ‘শের’- এর সাধারণ সম্পাদক জয়দীপ কুন্ডু বলছেন, “এটাই বাঘেদের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। দুর্যোগ এলে ওরা বুঝতে পারে। কোনও অরক্ষিত জায়গা অর্থাৎ গ্রামের দিকে তারা যায় না। জঙ্গলের গভীরে উঁচু কোনও জায়গায় চলে যায়। আবার ঝড় থেমে গেলে নিজেদের জায়গায় ফিরে আসে।” কিন্তু বনকর্মীদের দেখে সে হামলা না করে ফিরে গেল কেন? এক বিশেষজ্ঞের কথায়, “বাঘ ভিতু প্রজাতির জীব। হই-হট্টগোল তার পছন্দ নয়। ঘাবড়ে যায়। তাই বনকর্মীদের সামনে পড়ে কিছুটা ভয়ে কিছুটা বিরক্ত হয়েই সে ফিরে গিয়েছে।” বাঘের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তিনি আরও জানিয়েছেন, “খেয়াল করে দেখবেন, বাঘ কিন্তু ডিঙি নৌকাতেই হামলা চালায়। ভুটভুটি দেখলে কাছেও ঘেঁষে না। সেও ওই আওয়াজের কারণে।”
বাঘের সুস্বাস্থ্যের খবর বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও জানেন। বলছেন, “বাঘ গ্রামে ঢোকেনি। সে জঙ্গলেই আছে। তার দেখাও মিলেছে। সুস্থ সবলই আছে।” দপ্তর সূত্রে খবর, রক্ষী ও কর্মীরা গ্রামের বিপদ আবার একইসঙ্গে বাঘের বিপদের কথা মাথায় রেখে কখনও হাঁটু জলে নেমে, কখনও গলাজলে ডুবে জঙ্গলের কোণায় কোণায় নজরদারি শুরু করে দিয়েছিলেন। এক আধিকারিকের কথায়, “রক্ষী বা কর্মীরা প্রত্যেকেই সারা বছর নিজেদের জীবন বাজি রেখে বন আর তার প্রাণী বা উদ্ভিদ রক্ষার কাজ করেন। এটা তাঁদের রোজই করতে হয়। আর এখন তো জোরালো বিপদ।”
যাই হোক, শেষ পর্যন্ত বাঘের সুস্থ থাকার খবর তো মিলল। তার সঙ্গেই উঠে এল সুন্দরবনের অরণ্যের ক্ষতি আটকানোর প্রসঙ্গও। জয়দীপবাবুই বললেন, “এটা আসলে বাদাবনের মাহাত্ম্য। সাধারণ কংক্রিটের বাঁধের সঙ্গে ঝড় আটকাতে বাদাবনের এখানেই শক্তির ফারাক। সামুদ্রিক ঝড় আটকাতে পারে সুন্দরী, গরান, গেওয়ার মতো শ্বাসমূল, ঠেসমূলের মতো সব গাছ।” তাঁর কথায়, “সামান্য কিছু শিকড় জলের দাপটে মাটি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। কিন্তু কেউ ছিঁড়ে উপড়ে যাবে না। মাটিতে তাদের এমনই কামড়।” এখানেই রক্ষা পেয়ে গিয়েছে সুন্দরবন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.