ড: কণিক পালোধি: একটা, দু’টো নয়। বেশ কয়েকটা ত্রুটি ছিল। সময় নিয়ে, ধরে ধরে সব শুধরে নেওয়া হয়েছে। চার বছর লেগেছে ঠিকই। তবে এবার আমরা অনেক বেশি সাবধানি, অনেক বেশি সংযমী। আর আশাবাদীও। কেন? একে একে বলছি। চন্দ্রযান ২-এর যাত্রাপথের প্রথম দিকে কিন্তু সে রকম কোনও বাধা আসেনি। মসৃণভাবেই এগোচ্ছিল ইসরোর যান। সমস্যা তৈরি হয়েছিল অবতরণের আগে।
বিক্রম ল্যান্ডার (Lander Vikram) উপবৃত্তাকার কক্ষপথ ধরে এগিয়ে এসে, চাঁদের দিকে ঝুঁকে, যখন নামতে শুরু করে তখন চাঁদের জমি থেকে তার দূরত্ব মোটামুটি ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে। সেখান থেকে মোটামুটি ৭-৮ কিলোমিটার অংশকে বলে ‘রাফিং ব্রেক ফেজ’। এই পর্যায়ে ল্যান্ডার খুব তাড়াতাড়ি নিচে নামতে থাকে। এই পর্যায়ে উচ্চতার আনুমানিক মাপ পাওয়া যায় না। এর পরবর্তী ধাপ হল ক্যামেরা কোস্টিং ফেজ। এই ধাপে ল্যান্ডারের মধ্যে রাখা ক্যামেরা এবং আরও কিছু যন্ত্রপাতি ‘ক্যালিব্রেট’ হওয়া শুরু হয়। দ্বিতীয় চন্দ্রযানের ক্ষেত্রে ওই কারণে ‘থ্রাস্ট কন্ট্রোল’ কিছু সময়ের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছিল। আরও একটা বিষয়। আগের বার ‘অ্যাকিউরেট ল্যান্ডিং’ প্ল্যান করা হয়েছিল। আমার ধারণা, খুবই সংকীর্ণ পরিসরে যানটির অবতরণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এত ছোট্ট জায়গায় ‘ল্যান্ডিং’ করতে গেলে ক্যামেরার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাকে সারাক্ষণ নজর রাখতে হবে, সে কোন দিকে দেখছে। মহাকাশ বিজ্ঞানের ভাষায় যা পরিচিত ‘অ্যাটিচিউড কন্ট্রোল’ নামে।
ওই সময় সফটওয়্যারের ক্ষেত্রে দু’টো জিনিসকে নিয়ন্ত্রণ করা মুশকিল হয়ে গিয়েছিল। এক, রাফিং ব্রেক ফেজ-এ সাধারণভাবে যে থ্রাস্ট থাকার কথা (ক্যালকুলেশন থ্রাস্ট) তার থেকে থ্রাস্টের একটুও হেরফের হয়ে গেলে, যা স্পেসের ক্ষেত্রে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা, বিপর্যয় অবধারিত। খুব সম্ভবত, আগের বার ওই পর্যায়ে এসে থ্রাস্ট ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল। আর দুই, বর্ধিত এই ‘থ্রাস্ট’ কোনওভাবেই ক্যামেরা কোস্ট ফেজে এসে নিয়ন্ত্রণ করা গেল না। কারণ ওই সময় সফটওয়্যারের অন্য যন্ত্রপাতিগুলি ‘ক্যালিব্রেট’ করা হচ্ছে। ফলে সফটওয়্যারের কাছে চ্যালেঞ্জ যেটা দাঁড়াল–ল্যান্ডার যখন অবতরণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, তখন ওকে নিজের ক্যামেরাকে ঘুরিয়ে রাখতে হবে যেদিকে অবতরণ করছে সেই দিকে। অথচ ‘থ্রাস্ট’ বেড়ে যাওয়ায় ক্যামেরার মুখ বার বার অন্য দিকে ঘুরে যাচ্ছে। অনবোর্ড কম্পিউটারের সফটওয়্যারের এই সমস্যাগুলি তৈরি হয়েছিল। হ্যাঁ, অবশ্যই যাবতীয় ‘এরর কারেক্ট’ করা মানে ভুল শুধরে নেওয়ার ব্যবস্থাও ছিল। কিন্তু ভুলের বহর অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল, এতটা সংশোধন করার ক্ষমতা ছিল না। করতেও পারেনি। অবতরণের চার কিলোমিটার আগে যখন চন্দ্রযানের ‘থ্রাস্ট কন্ট্রোল’ ক্ষমতা ফিরে এল, তখন আর কিছু করার ছিল না।
ইসরোর চেয়ারম্যান এস সোমনাথের সাম্প্রতিক ভাষণের অংশবিশেষ পড়ে দেখুন। এই সমস্ত দিকই তুলে ধরেছেন তিনি। এখানে একটা জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখ না করলেই নয়। চন্দ্রযান ২-এর সফটওয়্যার ছিল ‘সাকসেস-বেসড ডিজাইন’। অর্থাৎ ধরেই নেওয়া হয়েছিল যে, পর পর অনেকগুলো ঘটনা ঠিকঠাকভাবে এগোবে, আর তা হলে ল্যান্ডারও ঠিকঠাকভাবে ‘ল্যান্ড’ করবে। মানে থ্রাস্টও বেশি হবে না, এররও কিছু হবে না, ক্যামেরাও ঠিকঠাক থাকবে, অ্যাটিটিউড কন্ট্রোলও হবে ইত্যাদি। বলাই বাহুল্য, এ সব কিছুই পরিকল্পনা-মাফিক হয়নি। ফলে শেষে গিয়ে ‘থ্রাস্ট’ এতগুণ বেড়ে গিয়েছিল যে, ল্যান্ডার অতটা ভার সহ্য করতে পারেনি। আমার ধারণা, এবারের অভিযানে অতি গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি সংশোধন করা হয়েছে। অনেকটা ভার সহ্য করতে পারে, এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে প্রযুক্তির সাহায্যে। আসলে, ‘সফট ল্যান্ডিং’ করতে গেলে যতটা ভার সহ্য করতে হয়, আগের বার সেই নেওয়ার ক্ষমতা ছিল না দ্বিতীয় চন্দ্রযানের। একটুখানি এদিক-ওদিক হলেই গন্ডগোলের আশঙ্কা ছিল। এবার সেই ক্ষমতা অনেকটাই বাড়ানো হয়েছে।
আর নতুন কী কী বিষয় যোগ হয়েছে? প্রথমত, দ্বিতীয় চন্দ্রযানের ‘ল্যান্ডিং’ ছিল ছোট্ট জায়গায়। তৃতীয় চন্দ্রযানে (Chandrayaan 3) তা অনেকটাই বাড়ানো হয়েছে। প্রায় চার বর্গ কিলোমিটার তো বটেই। আগের বার মাত্র চারশো বর্গমিটার ছিল। ফলে ক্যামেরাকে একটা নির্দিষ্ট দিকে মুখ করে থাকতে হবে, একটু এদিক-ওদিক ঘুরে, পছন্দসই জায়গা বেছে, নামার ‘চয়েস’ রয়েছে তার কাছে। আবার এবার ‘ম্যানুয়েভারিং’ করারও সুযোগও থাকছে। দ্বিতীয়ত, আগের তুলনায় এবার কমিউনিকেশন সিস্টেম আরও উন্নত করা হয়েছে। তৃতীয় চন্দ্রযান, তার পূর্বসূরির ‘অরবিটার’কেই কাজে লাগাচ্ছে। তার মারফতই এবার তার অনেক বেশি ‘কমিউনিকেট’ করার সুযোগ থাকছে। দ্বিতীয় চন্দ্রযানের বিক্রম ল্যান্ডারের ‘এক্সপেরিমেন্ট’গুলি ‘ওয়ান অফ দ্য বেস্ট’ ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সফল হয়নি। এবার একটাই পেলোড পাঠানো হয়েছে। ‘শেপ’। এই ‘শেপ’ চাঁদে ইসরোর পরবর্তী অভিযানের জন্য তথ্য পাঠাতে সহায়ক হবে। তৃতীয়ত, চন্দ্রযান ৩-এর সফটওয়্যার হল ‘ফেলিওর বেসড ডিজাইন’। অর্থাৎ এটি সংকটজনক পরিস্থিতির মুখে পড়লে অনেক বেশি তার মোকাবিলা করতে পারবে, কোথাও ভুল করলে তা চিহ্নিত করে সংশোধন করতে পারবে। সেই রকমভাবেই তৈরি করা হয়েছে এবারের চন্দ্রযানকে। অল দ্য বেস্ট, মেট!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.