ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়: অবতরণের সময়ে ল্যান্ডার বিক্রমের সঙ্গে ইসরোর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঘটনায় আপাতত সরগরম দেশের মহাকাশ গবেষণা। সমালোচনাও কিছু কম হচ্ছে না। তবে ভিনগ্রহ বা উপগ্রহে অবতরণের ইতিহাস ঘাঁটলে বেশ কিছু সাফল্যের সঙ্গে পাওয়া যায় অসংখ্য ব্যর্থতাও। সে তালিকায় সবচেয়ে বেশিবার নাম উঠেছে নাসার। তবে যতবার ব্যর্থ হয়েছে, ততবার নতুন করে চেষ্টা করেছে তারা। ফলে বহু ব্যর্থতার মধ্যে থেকেই সর্বাধুনিক অবতরণ প্রক্রিয়া খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছে নাসা। সফল হয়েছে অভিযানও।
জানা যাচ্ছে, মঙ্গলে অবতরণের কৌশলেই নাসা সবচেয়ে বেশি সবচেয়ে সাফল্য পেয়েছে। চাঁদেও তাদের অবতরণ পদ্ধতি যথেষ্ট প্রশংসিত। ভারতের চন্দ্রযান ২ চাঁদে অবতরণে ব্যর্থ হয়েছে। মুখ থুবড়ে কাত হয়ে পড়েছে ল্যান্ডার বিক্রম। কোন ধরনের অবতরণ সবচেয়ে বেশি নিরাপদ, তার তুল্যমূল্য বিচারের প্রসঙ্গ উঠছেই।
সাধারণত দু’রকমের অবতরণের কথা আমরা জানি বা দেখেছি। এয়ারব্যাগ ল্যান্ডিং ও কেব্ল ল্যান্ডিং। সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় হল এয়ারব্যাগ ল্যান্ডিং। পৃথিবী থেকে উড়ে মঙ্গলে গিয়ে নামতে নাসার সব ক’টি যানেরই সময় লেগেছিল সাত থেকে আট মাস। ১৯৯৭ সালে পাথফাইন্ডার ও ২০০৩ সালে স্প্রেট ও মার্স এক্সপ্লোরেশন মিশন বা অপরচুনিটি মঙ্গল গ্রহে এই পদ্ধতিতেই অবতরণ করেছে।
এয়ারব্যাগ ল্যান্ডিংয়ের বিষয়টি সহজ। অ্যাভিয়েশন বা উড়ান সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞানের ভিত থেকেই এর উৎপত্তি। মূল যানটিকে প্রথমে প্যারাশুটে করে মঙ্গলের আকাশে নামিয়ে দেওয়া হয়। যানটির দুই পিঠে দু’টি ঢাকনা থাকে। যে ঢাকনাটি গ্রহপৃষ্ঠের দিকে থাকে, সেটি তাপ-নিরোধক। পিছনেরটি মূল যানটিকে ঢেকে রাখার জন্য। গ্রহের পৃষ্ঠের কাছে এলেই সামনের ও পিছনের ঢাকনা খুলে গিয়ে ভিতর থেকে যানটি নেমে আসে। তখনও সেটি প্যারাশুটের সঙ্গে বাঁধা।
মূল যানটির গায়ে লাগানো থাকে সেই এয়ারব্যাগ। বায়ুমণ্ডলের সংস্পর্শে এসে সেটি খুলে যায়। টুকরো টুকরো বলের একটি শক্ত আধার তৈরি হয়ে যানটিকে ঢেকে ফেলে। ওই অবস্থাতেই ছেড়ে দেওয়া হয় সেটিকে। মাটিতে গিয়ে আছড়ে পড়ে। কিন্তু তার কোনও আঘাত লাগে না। শুধু লাল গ্রহের লাল ধুলো লেগেছে যানটির গায়ে। তবে এই অবস্থায় যানটির কোনও নির্দিষ্ট অবতরণস্থল থাকে না। বলগুলির সঙ্গে মাটির অভিঘাতে লাফাতে লাফাতে কিছুটা দূরে গিয়ে পড়ে।
দুই মঙ্গলযান স্প্রেট ও অপরচুনিটি যমজ ছিল। ২০১০ সালে স্প্রেটের মৃত্যু হয়। ধুলোর ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে মঙ্গলে আরও আট বছর বেঁচে ছিল অপরচুনিটি।তবে ২০১২ সালে কিউরিওসিটির অবতরণকে সবচেয়ে নিরাপদ বলা হয়। কারণ সেটিকে কেব্ল বা রশির মাধ্যমে নির্দিষ্ট জায়গায় নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। হুবহু একই পদ্ধতিতে যানটিকে মঙ্গলের পৃষ্ঠের কাছাকাছি এনে তার ঢাকনা খুলে দেওয়া হয়। একটি ক্রেনের মতো বস্তু থেকে কেব্লের সাহায্যে সেটিকে নামিয়ে দেওয়া হয় প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। মঙ্গলপৃষ্ঠে নেমে গেলে কেব্ল সমেত তার হোল্ডারটি ছিটকে যায়। তারপর কিউরিওসিটি নিজের কাজ শুরু করে।
সফট ল্যান্ডিং করে সাফল্যও এসেছে। নাসারই ফিনিক্স যান ২০০৮ সালে ও ইনসাইট ২০১৮ সালে সফট ল্যান্ড করে। ফিনিক্সের সাফল্যের জন্যই সেই পদ্ধতি অনুসরণ করে ইনসাইটকে অবতরণ করানো হয়। এই পদ্ধতি পুরোটাই স্বয়ংক্রিয়। রোবোটিক যানটিকে নিজের অবস্থানে হাওয়ার চাপ বুঝে রকেট থ্রাস্টার থেকে জ্বালানি পুড়িয়ে অবতরণ করতে হয়।
চাঁদে বিক্রমের ব্যর্থ অবতরণ নিয়ে যখন এত প্রশ্ন উঠছে, তখনই তথ্য পাওয়া যাচ্ছে নাসা শুধু এই ধরনের মিশনের উন্নতির ক্ষেত্রেই বহুল খরচ করেছে। মানবহীন হোক বা মহাকাশচারীদের নিয়ে অভিযান, নাসাই এখনও পর্যন্ত সেরা। ১৯৭২ সালে মহাকাশচারীদের নিয়ে অভিযানের ভিডিওটি দেখলে দেখা যাবে, কতটা উত্তেজনা ছিল মহাকাশচারীদের মধ্যে। তাদের যানের অবতরণকে শুধু আলতো লাফ বললে কম বলা হবে। একেবারে পাখির পালকের মতো পড়েছিল যানটি। রকেট থ্রাস্টার থেকে সময়মতো ও পরিমাণমতো জ্বালানি পুড়িয়ে পরিস্থিতি খতিয়ে অত্যন্ত সাবধানী হয়ে নেমে এসেছিল যানটি। তার পায়ে কোনও ক্ষতি হয়নি। সামান্য কাতও হয়নি। একেবারে নির্দিষ্ট জায়গায় ৪০ ফুট উচ্চতা থেকে পাখির পালকের মতো এসে পড়ে সেটি। রাশিয়াও একই পদ্ধতি অনুসরণ করে নিরাপদে নেমেছিল।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.