Advertisement
Advertisement

Breaking News

Bengali's space exploration

সুনীতা ফিরলেও শঙ্কু আজও নিরুদ্দেশ! বাঙালির ব্যোমযাত্রা এখনও থামেনি

বাঙালিকে প্রথম মহাকাশে পাঠানোর কৃতিত্ব অবশ্য জগদানন্দ রায়ের।

A write up about Bengali's interest in space exploration
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:March 22, 2025 8:53 pm
  • Updated:March 23, 2025 8:38 am  

বিশ্বদীপ দে: ‘কুচকুচে কালো আকাশ, তার মধ্যে অগণিত জ্বলন্ত গ্রহনক্ষত্র। নিউটন দেখে আর মাঝে মাঝে আস্তে লেজের ডগাটা নাড়ে। ওর কাছে বোধহয় ওগুলোকে অসংখ্য বেড়ালের চোখের মতো মনে হয়।’ বাঙালি মাত্রেই এই কয়েকটা লাইন পড়লেই বলে দিতে পারবে কোন গল্পের অংশ। প্রোফেসর শঙ্কুর ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’ পড়তে পড়তে আমরা আজও ভেসে বেড়াই অন্তরীক্ষের গহীন ঠিকানায়। সম্প্রতি সুনীতা উইলিয়ামস ফিরে এসেছেন মহাকাশ থেকে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত মহাকাশচারীর এই ‘বাস্তব’ অভিযান বাঙালির বুকের ভিতরে জেগে থাকা অচিন জগতের নেশাকে ফুটিয়ে তুলছে। আসলে বঙ্গদেশের নরম মাটির ভূখণ্ডে দাঁড়িয়েও পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে বাঙালির কল্পনামেঘ চিরকালই বহু দূর চলে যেতে জানে।

সুনীতা উইলিয়ামস মহাকাশে গিয়েছিলেন ৮ দিনের জন্য। কিন্তু যে যানে ফেরার কথা সেটা গেল বিগড়ে। তারপর থেকে ক্রমেই দীর্ঘ হয়েছে প্রতীক্ষা। সকালে উঠে খবরের কাগজে সুনীতার খবর দেখলে সকলেই মনে দিয়ে পড়ে দেখত তাঁর ও তাঁর সঙ্গী নভোচর বুচ উইলমোরের ফেরার কোনও আপডেট আছে কিনা। ডিজিটাল যুগে অবশ্য কেবল সংবাদপত্রের অপেক্ষায় মানুষ থাকে না। চ্যানেল হোক বা ওয়েব পোর্টাল, সবদিকেই নজর ছিল মানুষের। কবে ফিরবেন কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। আর ততই যেন বেশি করে মনে পড়ছিল শঙ্কুকে। কিংবা বিমল-কুমারকেও। সত্যজিতেরও বহু আগে হেমেন্দ্রকুমার রায় ‘মেঘদূতের মর্ত্যে আগমন’ নামের এক কাহিনিতে বিমল-কুমার-জয়ন্ত-মানিককে মহাকাশে পাঠিয়েছিলেন। তারা হাজির হয়েছিল মঙ্গলগ্রহে।

Advertisement
Sunita Williams braces for life on Earth
মহাকাশ থেকে ‘বাড়ি’র দিকে দেখছেন সুনীতা উইলিয়ামস

কিন্তু তা বলে বাঙালিকে প্রথম মহাকাশে পাঠানোর কৃতিত্ব কিন্তু হেমেন্দ্রকুমারেরও নয়। সেই কৃতিত্ব দিতেই হবে জগদানন্দ রায়কে। তিনি লিখেছিলেন ‘শুক্র ভ্রমণ’। ১৮৯৫ সালের ‘ভারতী’ পত্রিকার ১৯তম সংখ্যায় গল্পটি প্রকাশিত হয়। পরে ১৯১৪ সালে লেখকের ‘প্রাকৃতিকী’ নামের একটি সংকলনে ঠাঁই পেয়েছিল রচনাটি। মনে রাখতে হবে প্রায় একই সময়ে এইচজি ওয়েলস লিখেছিলেন ‘দ্য ওয়ার অফ দ্য ওয়ার্ল্ডস’। ১৮৯৫ থেকে ১৮৯৭ সালের মধ্যেই তা লেখা হয়েছিল। একই সঙ্গে আমেরিকা ও ব্রিটেনের ‘কসমোপলিটন’ ও ‘পিয়ার্সনস ম্যাগাজিন’-এ প্রকাশিত হয়েছিল এই কাহিনি। পরে বই আকারে বেরয় ১৮৯৮ সালে। গোটা বিশ্ব চমকে উঠেছিল ভিনগ্রহীদের পৃথিবীতে আসার সেই কাহিনি পড়ে। ভাবতে ভালো লাগে, একই সময়ে এক বঙ্গতনয়ও একই জঁরে কাহিনি ফেঁদেছিলেন! তাঁর কাহিনিতে গল্পের কথক চরিত্রটি তাঁর বন্ধুর সঙ্গে শুক্রগ্রহে যায়। সেখানে তাদের সঙ্গে মোলাকাত হয়েছিল এক শুক্রবাসীর। তার সারা শরীরে কালো পশম, বড় মাথা, দীর্ঘ নখ, লম্বা বাহু যেন বনমানুষের আদলকেই মনে করায়। রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য জগদানন্দ বাংলা কল্পবিজ্ঞানে হেমেন্দ্র-সত্যজিৎদের পূর্বসূরি। শান্তিনিকেতনে বিজ্ঞানের শিক্ষক পদে থাকা মানুষটি সেই ব্রিটিশ আমলে আমাদের মহাকাশের সুদূর কোণে নিয়ে গিয়েছিলেন কালো অক্ষরের স্পর্শে।

হেমেন্দ্রকুমার রায়

‘মেঘদূতের মর্ত্যে আগমন’ ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। এই কিশোর উপন্যাসে হেমেন্দ্রকুমার রায়ের দুই বিখ্যাত যুগল জয়ন্ত-মানিক এবং বিমল-কুমারকে একসঙ্গে দেখা গিয়েছিল। ‘এলিয়েন অ্যাবডাকশন’ বিষয়টিকে সেই যুগেও তিনি কাহিনির ভিতরে এনে ফেলেছিলেন। মঙ্গলের আশ্চর্য প্রাণীরা ‘মঙ্গল গ্রহের উড়োজাহাজে’ চাপিয়ে গল্পের প্রধান চরিত্রদের তুলে নিয়ে যায়। শেষে সকলে এসে পৌঁছয় মঙ্গলে। হেমেন্দ্রকুমার লিখছেন- ‘সন্ধ্যা উতরে গেছে। আকাশের দুই চাঁদ যেন পরস্পরকে দেখে হাসতে শুরু করে দিয়েছে– যদিও তাদের হাসির ক্ষীণ আলো চারিদিকের আবছায়া দূর করতে পারছে না।’ এই বর্ণনা পড়তে পড়তে সেই কোন যুগে বাঙালি কিশোর জানলার বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে পড়ত। আজকের কিশোররা এতে আচ্ছন্ন হবে কিনা জানা নেই। কিন্তু বাঙালির কল্পবিজ্ঞানচর্চায় এই জনপ্রিয় কাহিনিটি এক নিশ্চিত সংযোজন। হয়তো কাহিনি হিসেবে খুব অভিনব কিছু নয়। কিংবা এতে বিজ্ঞানের অংশটিও বেশ দুর্বল। কিন্তু কিশোরপাঠ্য এই কাহিনির অ্যাডভেঞ্চার বহু প্রজন্ম ধরে বাঙালিকে মহাকাশের অনন্তপ্রদেশের রোমাঞ্চ উপহার দিয়েছে।

কিন্তু সেই অর্থে এই কাহিনিও শঙ্কু কাহিনির জনপ্রিয়তার ধারেকাছে আসতে পারে না। অথচ ১৯৬১ সালে ‘সন্দেশ’ পত্রিকা নতুন করে শুরু করার পর কাহিনির অভাব ঘোচাতে কলম না ধরলে সত্যজিতের এই অসামান্য চরিত্রটিকে আমরা পেতামই না। আর সেই প্রথম কাহিনিই ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’। হিসেবমতো এটাই শঙ্কুর শেষ অভিযান। এরপর আমরা যা পড়েছি সবই এর আগের অভিযান। এটাই শেষ, কেননা প্রোফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু আর ফিরে আসেনি। সে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল নিজের বিড়াল নিউটন, ভৃত্য প্রহ্লাদ, রোবট বিধুশেখরকে। তারা গিয়ে নামে মঙ্গলগ্রহে। কিন্তু সেখানকার আশ্চর্য প্রাণীদের কবলে পড়ে কোনওমতে পৈতৃক প্রাণ বাঁচিয়ে তারা গিয়ে পড়ে টাফা গ্রহে। ‘সৌরজগতের প্রথম সভ্য মানুষ’রা নাকি সেখানে রয়েছে। এরপর শঙ্কুরা সেখানেই পাকাপাকি ভাবে থেকে যায়। সেখানকার মানুষরা কেমন? নস্যাস্ত্র প্রয়োগ করলেও তারা হাঁচে না। ‘হবে কী করে? এরা যে এখনও হাঁচতেই শেখেনি!’ এই সরস আখ্যান আসলে হালকা মেজাজেই লেখা। অনেকটা বাবা সুকুমারের ‘হেঁসোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি’র ছায়া রয়েছে তাতে। হয়তো সত্যজিৎ ভাবতেই পারেননি এই চরিত্রকে নিয়ে বছরের পর বছর তাঁকে কাহিনি লিখে যেতে হবে। পরবর্তী কাহিনিগুলির বয়ানভঙ্গি কিন্তু অনেকটাই সিরিয়াস। তবু আপাত হালকা চালে লেখা হলেও এই কাহিনির মধ্যেই যেন ধরা আছে বাঙালির মহাকাশ-প্রেমের সারাৎসার।

মঙ্গলগ্রহের প্রাণীদের মুখোমুখি শঙ্কু

পরবর্তী সময়ে লেখা ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’ কিংবা আরও নানা শঙ্কু কাহিনিতেও ভিনগ্রহী, মহাকাশ প্রসঙ্গ বারবার ফিরে এসেছে। ‘এলিয়েন’ (বা অবতার) নামের একটি ছায়াছবিও বানানোর পরিকল্পনা করে ফেলেছিলেন সত্যজিৎ। যে ছবির কথা জানতে পেরে কেঁপে উঠেছিল হলিউড-সহ গোটা বিশ্বের চলচ্চিত্র জগৎ। শুরু হয়েছিল তুমুল উন্মাদনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই ছবি হয়নি। অথচ ১৯৮২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘ইটি: দ্য এক্সট্রা টেরেস্ট্রিয়াল’ ছবির সঙ্গে আশ্চর্য মিল সত্যজিতের না হওয়া ছবির! যা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন খোদ সত্যজিৎই। তাঁর ধারণা ছিল তাঁর ছবির চিত্রনাট্যের অসংখ্য কপিই নাকি ছড়িয়ে গিয়েছিল হলিউডে। ফলে তা ‘লিক’ হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু যাবতীয় অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছিলেন স্পিলবার্গ। তিনি জানিয়েছেন, যে সময় সত্যজিৎ হলিউডে, সেই সময় তিনি নাকি নেহাতই স্কুলপড়ুয়া। যদিও তাঁর এই দাবি সত্যি নয়। ততদিনে হলিউডে ইন্টার্নশিপ শুরু করে দিয়েছিলেন তিনি। যাই হোক, এই বিতর্ক এক অন্য কাহিনি। এখানে এর বেশি বলার অবকাশ নেই।

‘পথের পাঁচালী’তে আমরা দেখি বাঁশঝাড়ের উপরে ছায়াভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা অপুকে। বিভূতিভূষণের দিনলিপিতেও মহাকাশের অনন্ত বিস্তারের ভিতরে মানুষের অস্তিত্বকেই খুঁজে ফেরার আকুলতা খুঁজে পাই। যা বুঝিয়ে দেয় এই আকুতি চিরকালই ছিল। রবীন্দ্রনাথের লেখাতেও কি আমরা তা পাইনি। কিন্তু সত্যজিতের পরে বাংলা সাহিত্যে ভিনগ্রহী ও মহাকাশ আরও প্রত্যক্ষভাবে আসতে থাকে। প্রেমেন্দ্র মিত্র, লীলা মজুমদার, অদ্রীশ বর্ধনদের হাত ধরে বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাবালক হয়ে ওঠে। সুনীতা উইলিয়ামস ফিরে এসেছেন। শঙ্কু ফেরেনি। বাঙালির স্বপ্নে সে আজও ভ্রাম্যমাণ। টাফাগ্রহে তার বাকি দিনগুলি কেমন কেটেছিল, তা জানা অসম্ভব। কেননা খোদ স্রষ্টাই যে ‘নিরুদ্দেশ’ বহুদিন। তবু তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের ভবিষ্যৎ জীবন আজও বাঙালি পাঠককে ভাবিয়ে তোলে। টাফাগ্রহের আকাশ-মাটির কল্পনায় বুঁদ করে তোলে। সুনীতার প্রত্যাবর্তন সেই কল্পনাকে রংমশালের মতো যেন জ্বালিয়ে তুলল নতুন করে।

A write up about Bengali's interest in space exploration
রোমাঞ্চপ্রিয় বাঙালির প্রিয় মানসক্ষেত্র অনন্ত মহাকাশ

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement
News Hub