বিপ্লবচন্দ্র দত্ত, কৃষ্ণনগর: তারাই ‘কৃষ্ণ’। আবার তারাই ‘রাধা’ও। ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সি গ্রামের ছেলেরাই সাজে কৃষ্ণ। আবার তারাই সাজে রাধা রুপেও। রাধাকৃষ্ণরূপে সাজা সেইসব ছেলেদেরই ভগবানজ্ঞানে পুজো করেন গ্রামের লোকজন। কৃষ্ণরূপে নিজের ছেলেকে পূজো করেন মা। তার সামনে বাড়িয়ে দেন শ্রীকৃষ্ণের পছন্দের খাবার। রাধাকৃষ্ণ সেজে শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন লীলা মানুষের সামনে তুলে ধরে গ্রামের ছেলেরা।
ফাল্গুন মাসের প্রথম রবিবার থেকে চৈত্র মাসের প্রথম রবিবার পর্যন্ত চলে কুঞ্জমেলা। বাদ থাকে শুধু শুক্রবার। রবিবার রাধাকৃষ্ণের মিলনের মধ্যে দিয়ে হল কুঞ্জমেলার সমাপ্তি। টানা প্রায় একমাস ধরে চলা উৎসবকে ঘিরে মেতে থাকেন নদিয়ার শান্তিপুরের ফুলিয়ার উমাপুর গ্রামের মানুষেরা। এই উৎসবের জন্য গ্রামের মানুষ কেনেন নতুন জামাকাপড়। সারাবছর ধরে উৎসবের জন্য জমিয়ে রাখেন টাকা।
১১৩০ বঙ্গাব্দে বাংলাদেশের ঢাকা জেলার বরাবধামে শ্রীকৃষ্ণের জীবনী সংক্রান্ত নানা ঘটনা ভক্তবৃন্দদের মাঝে উপস্থাপনের মাধ্যমে পুজো করে এই উৎসবের সূচনা হয়েছিল। পরবর্তীকালে শ্রীমৎ শশীমোহন বর্ধন ও শ্রীকুঞ্জমোহন দাসের উদ্যোগে নদিয়ার ফুলিয়ার উমাপুর অঞ্চলে শুরু হয় এই উৎসব। দুর্গাপুজো ও কালীপুজো বা অন্যান্য উৎসব নয়, টানা একমাস ধরে চলা কুঞ্জমেলায় এখানকার গ্রামের মানুষের কাছে সবথেকে বড় উৎসব। সারাটা বছর এখানকার গ্রামের মানুষ এই উৎসবের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন।বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষের বেশ কয়েকটি জায়গায় এই উৎসবের প্রচলন দেখা যায়। কোচবিহারের দু-একটি জায়গাতেও এই উৎসব হয়ে থাকে। প্রতিদিন সন্ধেয় শ্রীকৃষ্ণের নামকরণ, পুতনা বধ, মনিপারোনা, দধিমন্থন, বস্ত্রহরণ, রাসলীলা, মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকা সংক্রান্ত নানা ঘটনা অভিনয় করে ফুটিয়ে তোলেন ৫ থেকে ১৭ বছরের গ্রামের ছেলেরা।
প্রায় ৬৪ বছর ধরে ফুলিয়ার উমাপুর গ্রামে চলে আসছে এই উৎসব। গ্রামের ৫ থেকে ১৭ বছরের ছেলেরাই কৃষ্ণ সেজে করে অভিনয়। সেই ছেলেদের মধ্যে থেকেই কেউ কেউ সাজেন রাধা। উমাপুরেরই একটি কীর্তনদল বংশ পরম্পরায় প্রতিবছর করে আসছে কীর্তন। রবিবার রাধাকৃষ্ণের মিলন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শেষ হল একমাস ব্যাপী কুঞ্জমেলা। সোমবার হবে কবিগান। মঙ্গলবার বাউল গানের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবছরের মতো উৎসব। এই উৎসব উপলক্ষে রবিবার গ্রামের প্রায় সকলের বাড়িতেই ছিল আত্মীয় পরিজন এবং পরিচিতদের নিমন্ত্রণ। পথচলতি যেকোন মানুষই গ্রামের যেকোন মানুষের বাড়িতে গিয়ে গ্রহণ করতে পারেন প্রসাদ। এদিনের জন্য গ্রামের প্রতিটি মানুষের বাড়িতেই সকলের জন্য অবাধ দ্বার। মধ্যাহ্নভোজের জন্য সকলেরই রয়েছে নিমন্ত্রণ। গ্রামের মানুষ কাউকেই অভুক্ত রাখতে রাজি নন।
শ্রীচৈতন্যের পছন্দসই খাবার কচু শাক খাবারের মধ্যে অন্যতম একটি উপকরণ। উৎসব উপলক্ষে একমাস ধরে বসে মেলা। তবে মেলার প্রতিটি দোকানেই থাকে নিরামিষ খাবার। প্রত্যেকের বাড়ির উঠোনে মানকচু-সহ বিভিন্ন আনাজ রোপন করা হয় বিপুল পরিমাণে। ভক্তবৃন্দদের মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা খাদ্য উপাদান হিসেবে জোগানের উদ্দেশ্যে। প্রতিটি বাড়িতে গৃহিণীরা রান্না করেন শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় ডাল এবং কচুর শাক-সহ পঞ্চব্যঞ্জনাদি। দীর্ঘ একমাস ধরে চলে আসা এই অনুষ্ঠানের মাঝে বিরতি বলতে শুধুই প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার। একসময় ওই গ্রামের কাছাকাছি হাট বসত শুক্রবারে। এখন হাট না থাকলেও ওই দিনটা বিরতি হিসেবে মেনে আসছেন গ্রামবাসীরা। শান্তিপুর,ফুলিয়া এবং জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তবৃন্দদের সমাগম ঘটে। মূলত গ্রামবাসীরাই একমাস ধরে পালা করে বিভিন্ন দায়িত্ব নিয়ে উৎসবের বিপুল পরিমাণের খরচ করে থাকেন। ভক্তরা মানত করে সোনা, রুপোর বাঁশি, মুকুট দিয়ে থাকেন। তবে সম্প্রতি এই উৎসবকে কেন্দ্র করে তিল তিল করে গড়ে তোলা মন্দিরে রাখা সোনার রূপোর বাঁশি এবং অন্যান্য বাসনপত্র চুরি হয়ে যায়। এরপর উৎসব কীভাবে হবে, তা ভেবে ভেঙে পড়েছিলেন গ্রামের মানুষেরা। কিন্তু বহু ভক্তদের স্বেচ্ছায় সহযোগিতার হাত বাড়ানোর ফলে তা আবারও স্বমহিমায় অনুষ্ঠিত হয়েছে এবছরও।
উৎসব কমিটির পক্ষে হরেকৃষ্ণ রায় জানিয়েছেন, “মন্দির দালানের দামি বাসনপত্র, সোনা দানা চুরি হয়ে যাওয়ার পর আমরা কিছুটা ভেঙে পড়েছিলাম। তবে আবার আমরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। এ বছরও অনেক মানুষ সোনাদানা এবং বিভিন্ন বাসনপত্র ঠাকুরের উদ্দেশ্যে দান করেছেন। প্রতি বছর আমরা এই উৎসবের জন্য অপেক্ষা করে থাকি। গ্রামের মানুষ কেনেন নতুন জামাকাপড়। প্রত্যেকের বাড়িতে হয় নিরামিষ রান্না। আমন্ত্রণ সবার। এবছর বৈশাখ মাসের প্রথম দিন আমরা চাঁদা তুলে নতুন মন্দির নির্মাণ করব। বছরের একটি মাস ধরে আমরা এই উৎসব নিয়েই মেতে থাকি।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.