বিশ্বদীপ দে: নিম্নচাপের চোখরাঙানি। রেকর্ডভাঙা বৃষ্টিতে জল থইথই বাঙালির ঘরদোর-উঠোন। তবুও অপেক্ষা আর সইছে না। আকাশে সামান্য নীলের ছোঁয়া ফুটতে না ফুটতেই পেঁজা তুলোর পেজারে যেন বার্তা ফুটে উঠছে। মা আসছে (Durga Puja 2021)। আর সেই কাউন্টডাউনের আসল সূচনা যে মহালয়ায়, সে তো অনস্বীকার্য। আর মহালয়া মানেই কাকভোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ (Chandipath)। যা না শুনলে বাঙালির পুজোর আমেজ ষোলো আনা হয়ে ওঠে না। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র (Birendra Krishna Bhadra) ও চণ্ডীপাঠ একেবারে সম্পৃক্ত হয়ে রয়েছে। কিন্তু চণ্ডীপাঠ যদি শোনা যেত নারীকণ্ঠে? সম্প্রতি চার মহিলা পুরোহিতের দুর্গাপুজো করা নিয়ে বিতর্ক ঘনিয়েছে। যার একটি অংশ এই চণ্ডীপাঠ সংক্রান্ত। কিন্তু আদৌ কি নারীকণ্ঠে চণ্ডীপাঠ নিয়ে আপত্তির কিছু আছে? বরং কোনও কোনও দিক বিচার করে মনে হয় সেটাকেই হয়তো অনেক বেশি সুপ্রযুক্ত হিসেবে ধরা যেতে পারে।
সেকথায় বিস্তারে আসার আগে একটা গানের কথা বলা যাক। ‘ললিতা ওকে আজ চলে যেতে বল না’। কেবল এই এক লাইন শুনলেই মনের মধ্যে বেজে ওঠে মান্না দে’র শাশ্বত কণ্ঠস্বর। অথচ এই গান তো আসলে রাধার উবাচ। ‘নিশিরাতে বাঁশি তার সিঁধকাটি হয়ে/ চুপি চুপি ঘরে এসে বাজে রয়ে রয়ে’ এ তো বংশীধারী কৃষ্ণপ্রেমে ডগমগ রাধার ছদ্ম অভিমান। অথচ দশকের পর দশক এক পুরুষকণ্ঠের উচ্চারণে তাকে মেনে নিতে শ্রোতার কোনও অসুবিধে হয়নি।
আসলে অভ্যাস এক বিষম বস্তু। গত শতকের তিনের দশক থেকে রেডিওয় বেজে ওঠা মহালয়ার সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে রয়েছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কণ্ঠস্বর। ভোরের ময়ূরকণ্ঠী নীলচে অন্ধকার আর বাতাসে শিউলি-সুবাসের সঙ্গে যা এক অনন্ত জলছাপের মতো লেগে রয়েছে। হয়ে উঠেছে অনতিক্রম্য। ১৯৭৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মহালয়ার ভোরে ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম’ নামে এক অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়েছিল। মহানায়ক উত্তমকুমার ছিলেন সেই অনুষ্ঠানের প্রধান ভাষ্যপাঠক। বাঙালি যে তাঁকেও মেনে নেয়নি, তা এক নাগরিক কিংবদন্তি হয়ে উঠেছে। যে কিংবদন্তি আসলে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের চিরকালীন ম্যাজিকেরই এক সম্প্রসারিত অংশ।
যাই হোক, এই লেখার বিষয় তা নয়। আমরা কেবল নারীকণ্ঠে চণ্ডীপাঠের প্রসঙ্গেই থাকব। আর সেপ্রসঙ্গে অবধারিত ভাবেই এসে পড়ে ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’ প্রসঙ্গ। এই মহাগ্রন্থে এমন শ্লোকও রয়েছে যা আসলে দেবী চণ্ডীরই উবাচ। এই অংশটি ‘দেব্য়ুবাচ’ অর্থাৎ দেবীর উবাচ বলেই উল্লিখিত রয়েছে। যেমন, মহিষাসুরের সঙ্গে প্রবল যুদ্ধের সময় দিব্যসুরা পান করতে করতে দেবী বলছেন, ”গর্জ গর্জ ক্ষণং মূঢ় মধু যাবৎ পিবাম্যহম। / ময়া ত্বয়ি হতেহত্রৈব গর্জিষ্যন্তাশু দেবতাঃ।।” স্বামী জগদীশ্বরানন্দের বাংলা রূপান্তরে যার অর্থ, ”রে মূঢ়, যতক্ষণ আমি মধু পান করি ততক্ষণ তুই গর্জন কর। আমি তোকে বধ করলে ইন্দ্রাদি দেবগণ এই স্থানে শীঘ্রই গর্জনধ্বনি (আনন্দধ্বনি) করিবেন।” এতদিনের অভ্যাসে আমাদের চিনে নিতে অসুবিধা হয় না এই অংশটি। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর কণ্ঠে দেবীর এই সংলাপ ও তারপরই ঋষি মেধার বর্ণনায় মহিষাসুরের উপরে দেবীর শূলাঘাতের অংশটি শুনতে অভ্যস্ত বাঙালি কণ্ঠ দু’টিকেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কণ্ঠেই আপন করে নিয়েছে।
এমন উদাহরণ আরও রয়েছে। ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’র দ্বাদশ অধ্যায়েও রয়েছে দেব্যুবাচ। ‘এভিঃ স্তবৈশ্চ মাং নিত্যং স্তোষ্যতে যঃ সমাহিতঃ/ তস্যাহং সকলাং বাধাং নাশয়িষ্যাম্যসংশয়ম।। /মধুকৈটভনাশঞ্চ মহিষাসুরঘাতনম/ কীর্তয়িষ্যন্তি যে তদবদ বধং শুম্ভনিশুম্ভয়োঃ।।’ স্বামী জগদীশ্বরানন্দের অনুবাদে যার অর্থ, ”যে ব্যক্তি এই সকল স্তব দ্বারা সমাহিতচিত্তে নিত্য আমার স্তব করিবে, আমি তাহার ঐহিক ও পারত্রিক সকল বিপদ নিশ্চয়ই বিনাশ করিব।”
আসলে এই অংশগুলি দেবীকণ্ঠেরই উচ্চারণ। সুতরাং তা নারীকণ্ঠে শুনলে আপত্তির কিছু যে থাকতে পারেই না, না তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এখানে একটা কথা পরিষ্কার করে নেওয়া যেতে পারে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ তাঁর অননুকরণীয় জাদুতেই চিরকালীন হয়ে রয়েছেন। থাকবেনও। আমরা কেবল এরই সমান্তরালে নারীকণ্ঠে চণ্ডীপাঠের সারবত্তাটুকুই আলোচনায় রাখার চেষ্টা করছি।
আর এপ্রসঙ্গেই এসে পড়ে ‘দেবীসূক্ত’র প্রসঙ্গও। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই ভারতে শক্তিপূজার প্রচলন। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের দশম অনুবাকের ১২৫তম সূক্তকে বৈদিক দেবীসূক্ত বলা হয়। মনে করা হয় এই সূক্ত থেকেই শক্তির আরাধনার সূচনা। স্বামী জগদীশ্বরানন্দের লেখা ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’র ভূমিকায় রয়েছে, অষ্টমন্ত্রাত্মক দেবীসূক্তের ঋষি ছিলেন মহর্ষি অম্ভূণের কন্যা ব্রহ্মবিদূষী বাক। বাক ব্রহ্মশক্তিকে স্বীয় আত্মারূপে অনুভব করিয়া বলিয়াছিলেন, ‘আমিই ব্রহ্মময়ী আদ্যাদেবী ও বিশ্বেশ্বরী।’ অর্থাৎ সেই আদিকালের মহাঋষির বিদূষী কন্যার মধ্যে কার্যত ‘ভর’ হয়েছিল দেবীর। এরপর তাঁর মুখনিঃসৃত সংলাপেই পাওয়া যায় দেবীর বাণী।
এভাবেই একেবারে শুরু থেকেই শক্তি আরাধনায় বারবারই অনুরণিত হয়েছে স্বয়ং দেবীর সংলাপ। কখনও তিনি মহিষাসুরের মতো দৈত্যের নিধনের আগে হুঙ্কার করছেন। আবার কখনও ভক্তদের উদ্দেশে কথা বলছেন। ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’-তে ঋষিকণ্ঠের অংশের সঙ্গে সম্পৃক্ত এই দেব্যুবাচ। দেবীর উবাচ। তাই তা নারীকণ্ঠে শুনলে ‘গেল গেল’ রব তোলা অর্থহীন। কেবল প্রচলিত কাঠামোর সঙ্গে অমিল থাকার কারণেই তাকে সরিয়ে রাখার কথা বলাটা কোনও যুক্তি হিসেবেই টিকতে পারে না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.