বিকাশ মুখোপাধ্যায়: তিনি পরিব্রাজক। তাঁর পদক্ষেপ দীপ্ত। শরৎ-সকালের রোদ্দুর তাঁর চোখে-মুখে পড়ে ধন্য হচ্ছে। নবপত্রিকাকে তিনি দু’হাতে জড়িয়ে কাঁধের ওপর ফেলে এগিয়ে চলেছেন। তাঁর পিছনে সুশৃঙ্খলভাবে চলা মঠসেবক থেকে সাধারণ মানুষ। ঢাকের কাঠিতে মিঠে বোল। শাঁখের আওয়াজে চারপাশ মুখরিত। গন্তব্য সামনের গঙ্গার ঘাট। সপ্তমীর বোধনের আগে নবপত্রিকা স্নান করানো হবে। মানুষটি সটান জলে নেমে গেলেন। নিজেই নবপত্রিকাকে স্নান করালেন। ঢাকিদের সবাদন উল্লাস নাচ। শঙ্খধ্বনি দ্বিগুণ। উনিশ শতকের একেবারে শেষের দিকের ঘটনা এটি। বেলুড় মঠের দু্র্গামণ্ডপ থেকে কলাবউকে কাঁধে নিয়ে বেলুড় ঘাটে স্নান করালেন যিনি, তিনি স্বামী বিবেকানন্দ। বেলুড় মঠে দুর্গাপুজোর প্রচলন উনিই করেছিলেন।
গঙ্গার দু’দিকে নামী ঘাটগুলোর এক-একটা ইতিহাস আছে। এই ঘাটটিকে ঐতিহাসিক করেছেন স্বয়ং স্বামীজি। এখন আমরা সপ্তমীতে নবপত্রিকা স্নান করানোর কয়েকটি বিখ্যাত ঘাটের কথা বলব। ইতিহাস নিয়ে একটু আলোচনা করব। শুরু করছি জগন্নাথ ঘাট দিয়ে। এখন ফুলে ফুলে ফুলাক্কার এই ঘাটে একদা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদার্পণ ঘটেছিল। এখন এই ঘাটে নবপত্রিকা স্নান করাতে আসে কলকাতার দুই নামী পুজো- কলেজ স্কোয়ার সর্বজনীন ও মহম্মদ আলি পার্ক।
এই ঘাট থেকেই রবিঠাকুর বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে রাখিবন্ধন উৎসব শুরু করেছিলেন। এখানেই প্রথম গাওয়া হয়েছিল, ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল….।’ রবি ঠাকুরের সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ, দীনুঠাকুর প্রমুখরা ছিলেন। এখানে স্নান করার জন্যে তাঁরা রীতিমতো মিছিল করে, ঢাক-শঙ্খধ্বনির আওয়াজে চারিদিক মুখরিত করে এসেছিলেন। স্নান করার পর প্রত্যেকে একে-অপরকে রাখি পরিয়ে, এমনকী ঘাটের সাধারণ লোকজনদের রাখি পরিয়ে আবার হাঁটতে আরম্ভ করেন। রবীন্দ্রনাথ নিজে কাছের আস্তাবলের মুসলমান সহিসদের, পরে নাখোদা মসজিদের মৌলবিদের রাখি পরিয়েছিলেন। সেদিন থেকে এই ঘাট পুণ্যস্থান। এমনিতে ইংরেজদের সঙ্গে ব্যবসা করে সে যুগে কোটিপতি হওয়া শোভারাম বসাকের প্রতিষ্ঠিত ঘাট এটি। তাঁদের গৃহদেবতা জগন্নাথের নামে জগন্নাথ ঘাট।
অতঃপর বাগবাজার ঘাটে যাব। এখানে বাগবাজার সর্বজনীন, কারও কারও মতে কলকাতার সবচেয়ে পুরনো বারোয়ারি পুজোর কলাবউ স্নান করানো হয়। এ ঘাটে একদা মা সারদার পদচিহ্ন পড়েছিল। তাঁর নামেই পাশের ঘাট ‘মায়ের ঘাট’। এখন মায়ের বাড়িতে যে দুর্গাপুজো হয়, তার নবপত্রিকাও এই ঘাটে স্নান করানো হয়। বাগবাজার ঘাটের পোশাকি নাম রাজা রাজবল্লভ ঘাট। রাজবল্লভ সিরাজদ্দৌলার উপ-প্রধানমন্ত্রী রায়দুর্লভের ছেলে। রায়দুর্লভের সিরাজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার কথা আমরা জানি। লর্ড ক্লাইভ তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসেন। ছেলে রাজবল্লভ কিন্তু পিতার অন্ধ অনুগামী হওয়ার থেকে জনসেবায় বেশি মন দেন। সাধারণের জন্যে তাঁর তৈরি করানো এই বাগবাজার ঘাট। এই ঘাট থেকে এখন ভক্তরা জল নিয়ে তারকেশ্বর, লোকনাথ বাবার আশ্রমে পুজো দিতে যায়।
তালতলা এলাকার বিখ্যাত জানবাজারের দুর্গাপুজোর বোধনের নবপত্রিকা যে ঘাটে স্নান করানো হয়, সেটি রানি রাসমণির স্বামী বাবু রাজচন্দ্র দাস প্রতিষ্ঠিত বাবুঘাট। রাজচন্দ্র ১৮৩০ সালে এই ঘাট তৈরি করেন। নাম ছিল বাবু রাজচন্দ্র ঘাট, সাধারণের মুখে মুখে বাবুঘাট হয়ে গিয়েছে। রাজচন্দ্রের তৃতীয়া পত্নী ছিলেন রানি রাসমণি। বাবুঘাটে লোকজনদের যাওয়ার সুবিধার জন্যে রাজচন্দ্র চৌরঙ্গি থেকে ঘাট অবধি পাকা চওড়া রাস্তা করিয়ে দিয়েছিলেন। বর্তমানে যেটি রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ। হাটখোলার ঘাটও এঁদের তৈরি। দক্ষিণেশ্বর মন্দির, টিটাগড়ের অন্নপূর্ণার মন্দির, যদুবাবুর বাজারও এঁদের প্রতিষ্ঠিত।
এবার আসি কুমারটুলি ঘাটের কথায়, যেখানে কুমারটুলির বিখ্যাত দুই পুজো কুমারটুলি পার্ক আর কুমারটুলি সর্বজনীনের নবপত্রিকা স্নান থেকে প্রতিমা নিরঞ্জন সবই হয়। এর নামকরণ কোনও মনীষী বা প্রতিষ্ঠাতার নামে হয়নি। এলাকার কারণেই হয়েছে। কুমারটুলির প্রতিমা তৈরির ইতিহাস এককথায় কলকাতায় প্রাচীনতম। এখনও যেমন প্রতিমা তৈরির মাটি নদীপথে এই ঘাটে এসে নামে, তেমনই একদা দূরদূরান্ত থেকে নৌকায় বোঝাই হয়ে বাঁশ, খড় থেকে মাটি ও অন্যান্য সরঞ্জাম এই ঘাটে এসে নামত।
এবার শোভাবাজার ঘাট। জগন্নাথ ঘাটের প্রতিষ্ঠাতা শোভারাম বসাকের আরেকটি ঘাট হল শোভাবাজার ঘাট। তাঁর নামেই এই ঘাট। এখন যেখানে শোভাবাজার রাজবাড়ি, সেখানেই এঁর সবজিবাগান ছিল। সেখানে উৎপন্ন সবজি বাগানেই বিক্রি হত। তাই শোভাবাজার নাম। শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোর নবপত্রিকা বিশাল মিছিল করে শোভাবাজার ঘাটে স্নান করাতে নিয়ে যাওয়া হয়। নবপত্রিকার ওপরে চাকচিক্যওয়ালা বিশাল ছাতা ধরা থাকে, যেন কোনও মহারাজ বা মহারানির মাথায় ছাতা ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সবমিলিয়ে এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। এই অভিজাত ঘাটের মুখ এখন বিশাল বিশাল ঝুরিতে ঢাকা। পাশের লঞ্চঘাট থেকে দেখলে ঘোমটা দেওয়া কলাবউয়ের মতো লাগে। এর একটু পাশের যে এলাকা দুর্গাপুজোর দিনগুলি থেকে বিসর্জন অবধি জমজমাট থাকে, সেই আহিরিটোলা পার্ক ও বি. কে. পাল অ্যাভিনিউয়ের কলাবউ স্নান থেকে প্রতিমা নিরঞ্জন হয় আহিরিটোলা ঘাটে। সংস্কৃত ‘আভীর’ থেকে ‘আহির’। যার অর্থ হল গোয়ালা, আহিরনাথ হলেন শ্রীকৃষ্ণ।
প্রতিবেদনের শেষ পর্যায়ে এসে রতনবাবুর ঘাটের কথা বলব। এর সংলগ্ন কাশীপুর ঘাটেই রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, অভেদানন্দ, গৌরীমাতা, জংলিবাবা প্রমুখ সাধকেরা ও মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত এবং নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ীর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছিল। নড়ালের জমিদাররা এই শ্মশানঘাটের সঙ্গে স্নানাদি করানোর জন্যে সংলগ্ন রতনবাবুর ঘাটও নির্মাণ করেন। সিঁথি বরানগর এলাকার নামী পুজোগুলোর নবপত্রিকা স্নান এখানেই হয়।
গঙ্গার তীর বরাবর বহু ঘাটেই কলাবউ স্নান করানো হয়, এর মধ্যে কয়েকটি ঐতিহাসিক কারণে বিখ্যাত ঘাটের কথা এখানে বলা হল।
১৫৩৭ সালে যখন ওলন্দাজ ও পর্তুগিজরা গঙ্গার পাড়ে ব্যবসা শুরু করলেন, তখনই ঘাটগুলো তৈরি হওয়া শুরু হয়। কলকাতায় দুর্গাপুজোর আরম্ভ আরও কিছু পরে। অতএব শুরু থেকেই নবপত্রিকা স্নান থেকে বিসর্জন- এই সমস্ত ঘাটেই হয়ে আসছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.