অনির্বাণ চৌধুরী: বাহন অনেকটাই দেবতাদের স্বরূপের অংশ! খেয়াল করে দেখলে বাহন ছাড়া যেমন দেবতার দেবত্ব পূর্ণ মহিমায় উদ্ভাসিত হয় না, ঠিক তেমনই আবার ওই বাহন নির্বাচনের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে তাঁদের ব্যক্তিত্ব আর পরাক্রমের ইঙ্গিত। দুইকে কিছুতেই আলাদা করা যায় না।
অবশ্য, দেবী দুর্গা স্বেচ্ছায় তাঁর বাহন বেছে নেননি। সেই সুযোগ তাঁর ছিল না। মহিষাসুরের প্রবল অত্যাচার থেকে ত্রস্ত সৃষ্টিকে রক্ষা করার জন্য সম্মিলিতি দেবপুঞ্জে তাঁর উদ্ভাস। দেবতারাই তাঁকে সাজিয়ে দেন বসনে আর ভূষণে। হাতে তুলে দেন অসুর বধের উপযোগী দুর্ধর্ষ দশ প্রহরণ। এবং, পর্বত হিমালয় একটি পার্বত্য সিংহকে উপহার দেন দেবীর বাহন হিসাবে। বিন্ধ্যাচলে, কাত্যায়ন ঋষির আশ্রমে, তেজোপুঞ্জ থেকে কায়া ধারণ করার সেই মুহূর্ত থেকেই দুর্গা সিংহবাহিনী। আবার, শ্রীশ্রীচণ্ডীর আরও একটি শ্লোকের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে দেখা যাবে, সেখানে স্তবগাথায় বলা হচ্ছে- ‘সিংহস্তা শশীশেখরা মরকতপ্রেক্ষা/ চতুর্ভিভুজৈ শঙ্খং চক্র-ধনু: শরাশ্চ দধাতি/ নেত্রৈস্ত্রিভিঃ শোভিতা’! অর্থাৎ প্রসন্নবদনা, আয়তনেত্রা, শঙ্খ-চক্র-ধনু-শর ধারিণী চতুর্ভুজা দেবী সিংহবাহিনী, তাঁর মস্তকে অর্ধচন্দ্রের অলঙ্কার।
তাহলে সম্বৎসর দেবীর একেকটি মাধ্যমে পিতৃগৃহে আগমন এবং গমনের মানেটা কী? তিনি স্বরূপে সিংহবাহিনী, মণ্ডপেও তাই, অথচ একেকটি বছর তাঁর আগমন এবং গমন হচ্ছে সিংহ ছাড়াই! কখনও দেবী বেছে নিচ্ছেন নৌকা বা দোলার মতো যান, কখনও বা এই আসা-যাওয়ায় তাঁর সহায় হাতি বা ঘোড়া! সিংহ কখনই কেন নয়?
এর ব্যাখ্যা পুরাণে মেলে না। মেলা সম্ভবও নয়। কেন না, পুরাণ সর্বতোভাবেই মহামায়ার চিণ্ময়ী শক্তির জয়গান করেছে। সেখানে তিনিই আদি, তিনিই অন্ত, তিনিই মায়া এবং তিনিই বিশ্বাধার শক্তি। সেখানে তাঁর মানবায়ন হয়নি। সেখানে তিনি কন্যা নন, জায়া নন, শুধুই অযোনিজা দুর্গতিহারিণী আদ্যাশক্তি। অতএব, পিতৃগৃহে আসার দরকারও পড়েনি, সেই জন্যেই প্রয়োজন হয়নি মর্ত্যের যাতায়াতের মাধ্যমও। তাই যুদ্ধের দেবী পুরাণে সিংহবাহিনী হয়েই থেকেছেন!
অবশ্য, দেবীর রূপটিকে যদি এক্ষেত্রে শুধুই শিবপত্নীর স্তরে এনে দেখা যায়, তাহলে একবার, শুধু একবার, সেই শক্তিরূপিণীকে দেখা যাবে অন্য বাহনে। সে দক্ষযজ্ঞের সময়ের কথা। তখন শিবের বাহন নন্দীর পিঠে আসীন হয়েই সতী পৌঁছেছিলেন পিতৃগৃহে। এ ছাড়া গজে, ঘোটকে, নৌকায় বা দোলায় দেবীর আসীন হওয়ার ইঙ্গিত কোথাও নেই!
অনুমানসাপেক্ষ, দেবীর এই আগমন এবং গমনের ইতিবৃত্তের সূত্রটি রয়েছে জ্যোতিষবিদ্যায়। কেন না, সেই বিদ্যা তিথি-গ্রহ-নক্ষত্রের সমাবেশ অনুযায়ী জানিয়ে দেয়, বছরের একেকটি তিথিতে একেক রকমের দুর্ভোগের সম্মুখীন হবে মানবসভ্যতা। ব্যাপারটা অনেকটা রাশিফলের সুপ্রভাব-কুপ্রভাবের মতো! তার সঙ্গেই যুক্ত হল দেবী মহামায়ার প্রসঙ্গও। স্পষ্ট বুঝিয়ে দেওয়া হল, দেবীকে এই সাদর আমন্ত্রণের মধ্যেও যে দেখা যাচ্ছে অপচয়ের আভাস, তা তাঁর ইচ্ছা ব্যতীত আর কিছুই নয়। সৃষ্টি আর লয়ের ভারসাম্য বজায় রাখতেই তাঁর এই লীলা।
অতএব, উমার আগমন-গমন সূত্রবদ্ধ হল গজ, ঘোটক, নৌকা আর দোলায়। খেয়াল রাখা জরুরি- রথ কখনই নয়! কারণ, দেবী আসছেন কৈলাসের পর্বতশৃঙ্গ থেকে। পাহাড়ি পথে হাতি চলতে পারে, চলতে পারে ঘোড়াও! কিন্তু, পথের বন্ধুরতার জন্যই রথ চালানো সম্ভব নয়। তেমনই, পাহাড় থেকে নদীপথে নৌকাবক্ষে দেবী পৌঁছতে পারেন শস্যশ্যামলা বঙ্গের পিতৃভূমিতে। পাহাড়ি পথেই তাঁকে বহন করে আনতে পারেন দোলাবাহকরাও!
আর, দেবীর এই আসা-যাওয়ার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে ভবিতব্যের ইঙ্গিত। জ্যোতিষীরা স্পষ্ট বলে দেন তিথি-গ্রহ-নক্ষত্রের ছক ধরে- কোন দিনে কোন মাধ্যমে দেবী এলে ধরা তার কীরকম পরিণাম ভোগ করবে! “রবৌ চন্দ্রে গজারূঢ়া, ঘোটকে শনি ভৌময়োঃ, গুরৌ শুক্রে চ দোলায়াং নৌকায়াং বুধবাসরে।” অর্থাৎ সপ্তমী তিথি যদি যদি রবিবার এবং সোমবারে পড়ে, তাহলে দুর্গার আগমন ও গমন হবে গজে। ফল-“গজে চ জলদা দেবী শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা”। ব্যাখ্যা বলছে, দেবীর এই গজে আগমন এবং গমনে পৃথিবী শস্যে পরিপূর্ণ হবে। সর্বত্রই বিরাজ করবে সুখ। একটু তলিয়ে ভাবলে চোখেও পড়বে যে হাতি প্রধানত সুখী প্রাণী। সে খুব ধীরে ধীরে গতায়াত করে। তাই দেবীর গজে আগমন-গমন শেষ পর্যন্ত শুভেরই প্রতীক।
ঘোড়া কিন্তু তা নয়! স্বভাবগুণে সে দ্রুতগামী, চপল, চঞ্চল। এই চপলতা, এই চঞ্চলতাই এক সময়ে গিয়ে ধ্বংসের কারণ হয়। তাই বলা হচ্ছে, শনিবার ও মঙ্গলবারে দুর্গার আগমন ও গমন হলে সেখানে ঘোটকের প্রভাব থাকবে। এবং ফল হবে- “ছত্রভঙ্গস্তুরঙ্গমে”। ঘোড়ায় এই আগমন ও গমনে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংসারিক ক্ষেত্রেও অস্থিরতা প্রকাশ পাবে; সব ছত্রভঙ্গ হবে। রাজনৈতিক উত্থান, পতন, সামাজিক স্তরে বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা, গৃহযুদ্ধ, দুর্ঘটনা, অপমৃত্যুর মুখোমুখি হতে হবে দেশকে।
অন্য দিকে, নৌকায় অশ্বের তীব্র বেগ নেই! তা যেন অনেকটা গজের মতো মৃদুগতির দ্যোতক। এই মাঝামাঝি অবস্থানে দাঁড়িয়ে দেবীর নৌকায় আগমন এবং গমন ধরে রেখেছে শুভ, অশুভ দুই ঘটনাকেই। যদি বুধবারে দেবী দুর্গার আগমন ও গমন হয়, তাহলে তার মাধ্যম হবে নৌকা। ফল-“শস্যবৃদ্ধিস্তথাজলম”। এ ক্ষেত্রে প্রবল বন্যা, ঝড়, অতিবৃষ্টি ইত্যাদির জন্যে একদিকে যেমন প্লাবন ও ক্ষয়ক্ষতি হবে, তেমনই অন্য দিকে দ্বিগুণ শস্যবৃদ্ধি হবে মানুষের সভ্যতায়। কেন না, নৌকার ঈষৎ ধাক্কা জলরাশিকে নিয়ে আসে যে তটের কাছে!
কিন্তু, দেবীর এই আগমন-গমনের মাধ্যমগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক বোধ হয় দোলা! প্রথম থেকেই তা এক ভার হিসাবে দেখা হয়েছে যেন! সেই ভার যেমন বহনকারীদের, তেমনই মর্ত্যের মানুষেরও। অতএব, দুর্গার আগমন-গমন যদি বৃহস্পতি ও শুক্রবারে হয়, তাহলে তিনি দোলায় আসবেন এবং ফিরবেনও তাতেই। ফল-“দোলায়াং মরকং ভবেৎ”। মহামারী, ভূমিকম্প, যুদ্ধ, মন্বন্তর, খরা ইত্যাদির প্রভাবে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু তো ঘটবেই, আবার সেই সঙ্গে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দরুন ক্ষয়ক্ষতিও কম হবে না। অর্থাৎ গজ বাদে ঘোটক-নৌকা-দোলা এই তিনই দেবীর সৃষ্টিলয়ের মাধ্যম।
গণনা বলছে, এই বছরে দেবীর আগমন এবং গমন দুইয়েরই মাধ্যম ঘোটক। সংবাদটিকে খুব একটা সহজ ভাবে নেওয়া যাচ্ছে না। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ইঙ্গিত স্পষ্ট নিহিত দেবীর এই অশ্বে গতায়াতে। এ ছাড়াও এই বছরের পূজা তিথির দোষে দুষ্ট হয়েছে। এবছরে নবরাত্রি ৯দিনের সীমা অতিক্রম করে পা রেখেছে ১০ দিনে। সেই হিসেব অনুযায়ী, বিজয়াও আর দশমী দিবসে নয়, এসে দাঁড়িয়েছে একাদশ দিনে। যা শুভ লক্ষণ নয়, শাস্ত্রানুসারে ঘোরতর অশুভ ইঙ্গিত! তার উপরে আবার এ বছরে দশমী তিথি ন্যস্ত হয়েছে মঙ্গলবারে। এই বারে দেবীর প্রত্যাবর্তনেও অশুভ সত্ত্বা গ্রাস করে পৃথিবীকে, তার ফল বড় একটা ভাল হয় না।
খারাপের ইঙ্গিত কিন্তু ইতিমধ্যেই আমরা পেয়ে গিয়েছি ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের অবনমনে। দেবীর ঘোটকে আগমন-সংক্রান্ত সব ভবিষ্যদ্বাণীই যেন বা সত্যি হতে চলেছে! একেও কি মহাদেবীর মায়া বলেই ধরে নিতে হবে?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.