গ্রাফিক- সুলগ্না চক্রবর্তী।
শুভব্রত ধর: ছোট্ট বিলের নরেন থেকে স্বামী বিবেকানন্দ হয়ে ওঠার পথে বারবার উঠে এসেছে একাধিক ঘটনা। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব আর স্বামী বিবেকানন্দের মিলিত আধারে বারবার বিবর্তিত হয়েছে নীতি-আদর্শ আর ভালো থাকার মূলমন্ত্র। অনেকেই জানেন, স্বামী বিবেকানন্দ (Swami Vivekananda) আর দক্ষিণেশ্বরের (Dakshineswar Temple) ভবতারিণীর চিরন্তন সম্পর্কের কথা। কিন্তু স্বামীজির সঙ্গে ছিল কলকাতার আরও এক কালীতীর্থ কালীঘাটের (Kalighat Kali Temple) নিবিড় যোগাযোগ। মহাসাগরের মতো বিস্তৃত এই জ্ঞানের পথে নিরন্তর অতিবাহিত হয় যা।
ছোটবেলায় স্বামীজি ছিলেন ডানপিটে। বিলের অসুখ করত মাঝে মাঝেই। এমনকী তাঁর বড় হয়ে ওঠা, জীবনযাপনের নানা ত্রুটিতেও ছিল অসুখ-বিসুখের প্রকোপ। কোনও এক সময়ে অসুখ করল নরেন্দ্রনাথের। তখন তিনি বয়সে বেশ বড় হয়েছেন। যুবক নরেনের অসুখে চিন্তিত হলেন তাঁর মা। নরেন্দ্রনাথ দত্তের মা কালীর কাছে মানত করলেন দণ্ডি কাটার। তিনি বিশ্বাস করতেন, ছেলের অসুখ সারবে কালীর কৃপাতেই। এই খবর জানতেন না স্বয়ং নরেন। এই মানত সূত্রেই কালীঘাটের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয় বিবেকানন্দের। মায়ের মানত পূরণে কালীঘাটে দণ্ডি কাটেন স্বামীজি। আদিগঙ্গার ঘাটের কালীর সঙ্গে যোগ বাড়ে বিবেকানন্দের। তিনি বলেন, দক্ষিণেশ্বরের চেয়ে কালীঘাটের মন্দির অনেক বেশি স্বাধীন!
কেন দক্ষিণেশ্বর ছেড়ে কালীঘাটের কালীর কাছে যেতে হয়েছিল বিবেকানন্দকে? এরমধ্যেও রয়েছে এক অন্য ইতিহাস। ১৮৯৭ সালে দেশে ফিরলেন স্বামীজি। তখনও শ্রীরামকৃষ্ণের (Ramakrishna) পরলোকগমনের পরেও প্রত্যেক বছর তাঁর জন্মতিথিতে উৎসব হত দক্ষিণেশ্বরে। ১৮৯৮ সালে শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মতিথির উৎসব আয়োজিত হয় ওই একই স্থানে। বিদেশ থেকে ফিরে সেবার দক্ষিণেশ্বরে যান স্বামী বিবেকানন্দ। সেখানে প্রবল জনপ্রিয় স্বামীজিকে দেখার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড় হয়। এই ভিড় দেখে চমকে যান গোঁড়া হিন্দুদের একাংশ। তাঁদের কুনজরে পড়েন স্বামীজি। দক্ষিণেশ্বরের মন্দির কর্তৃপক্ষের কানে দেওয়া হয় বিবেকানন্দ সম্পর্কে ভুল বার্তা! বলা হয়, সাহেবদের সঙ্গে মিশে অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়েছেন তিনি। ‘কালাপানি’ পার করেছেন স্বামীজি। এরপর বিবেকানন্দ দক্ষিণেশ্বরে গিয়েছেন বলে শুদ্ধ করা হয় মন্দির।
এর মধ্যেই নরেনের মা মানতের কথা জানান তাঁর সন্তানকে। এবার উপায়! বিবেকানন্দ দণ্ডি কাটার জন্য বেছে নেন কালীঘাট মন্দিরকে। তিনি যাবেন একথা শুনতেই সাজো সাজো রব শুরু হয় কালীঘাট মন্দিরে। সেখানে পুজো দেন বিবেকানন্দ। দণ্ডী কাটেন। মানত পূরণ হয় তাঁর মায়ের।
এই কালীঘাট এবং স্বামী বিবেকানন্দের সম্পর্কের একাধিক কথার মধ্যেই উঠে আসে রামকৃষ্ণ, স্বামীজির কাছের মানুষ নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষের (Girish Chandra Ghosh) নামও। আপাদমস্তক নাস্তিক দামাল গিরিশের আস্তিক হওয়ার পথেও রয়েছে বিবেকানন্দের কালী-যোগের কথা।
গিরিশের মনে তখন অন্য ভাব। একের পর এক প্রিয়জনের বিয়োগ তাঁকে কষাঘাত করে বোঝাচ্ছে যে শুধু পুরুষকার দিয়ে হবে না। দৈবকে মানতে হবে এবার। তাই তাঁর মনে সাধ জাগছে, তাঁর চেয়েও শক্তিশালী শক্তিকে জানতে হবে। সেই ভাব থেকেই গিরিশ নিযুক্ত হলেন মাতৃসাধনায়। কালীঘাট তাঁর প্রিয় স্থান হয়ে উঠল ক্রমশ। এরমধ্যেই দিবানিশি মায়ের কাছে যেতে শুরু করলেন গিরিশ। মাতৃভাবে, মাতৃসঙ্গীতে, তথা মায়ের ভাব বুঝতে তন্ত্রসাধনায় মগ্ন রইলেন নাট্যকার। অনেকেই হয়ত জানেন না, বিবেকানন্দ-রামকৃষ্ণ আবহের মধ্যেই বাগবাজারের লাগামছাড়া গিরিশ তন্ত্রসাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন কালীঘাট সূত্রেই। যদিও গিরিশের জীবনে তখনও আসেননি রামকৃষ্ণদেব। বন্ধ খামে থাকা চিঠিও পড়তে পারতেন গিরিশ। যেকোনও রোগের হোমিওপ্যাথি ওষুধ দিতে পারতেন তিনি। তবে গিরিশের ব্যক্তিগত তন্ত্রসাধনার বিরাজমানতার আধিক্যেও উঠে আসে সেই স্বামীজির মায়ের কথাও!
কালী, দুর্গা এবং বিবেকানন্দের ঈশ্বর-চিন্তার প্রকাশে উঠে আসে সারদা মায়ের (Sarada Maa) কথা। যাঁকে ‘জ্যান্ত দুর্গা’ বলেছিলেন স্বামীজি। এর পিছনেও যেন রয়েছে গিরিশ-যোগ। নাট্যকারের মাতৃভাবের উদ্রেকের কারণ হিসাবে বলা হয়, তাঁর জীবনে ঘটা শারীরিক এক যন্ত্রণার কথা। ‘বিসূচিকা’ নামের এক রোগ যা আধুনিককালে আমরা কলেরা বলে জানি। সেই রোগ যখন গিরিশকে মৃত্যুশয্যায় নিয়ে যায় তখন একদিন রাতে তীব্র দেহকষ্ট বিদীর্ণ করে নাট্যকারকে। স্বামীজি আবহেই শোনা যায়, গিরিশের স্বপ্নে কালীঘাটের গর্ভগৃহ হতে এক অপূর্ব দেবীমূর্তি লালপাড় সাদা শাড়ি পরে তাঁর সামনে আসেন। হাতে সন্দেশ ধরে স্নেহের আবেশে তিনি বলেন, ‘বাবা এটি খাও সেরে যাবে, তুমি যে কবি হবে!’ হতবাক গিরিশ তখন বলে ওঠেন, ‘কবি..?.. আমি কবি হতে চাই না।’ সেই দেবীমূর্তি স্নেহে তিরস্কার হেতু বোঝান , ‘ওরে পাগল, কবি মানে যে জ্ঞানী, তা জানিস না?.. নে এটি খা।’
গিরিশের স্মৃতিচারণায় তিনি বলেন, ‘সেই স্বপ্নের অনুভূতি এত তীব্র ছিল যে মুখেও সেই সন্দেশের স্বাদ পেলাম।’ তিনি অচিরেই সুস্থ হয়ে ওঠেন এরপর। আসলে এই মা ছিলেন স্বয়ং সারদা!
বাগবাজারে শ্রীশ্রী মা সারদা লজ্জাপটাবৃতা থাকতেন, শ্রীমুখ ঘোমটা দিয়ে ঢাকা থাকত। আমরা যে মায়ের ছবিতে তাঁর শ্রীমুখ দর্শন করতে পাই তা নিবেদিতার ঐকান্তিক ইচ্ছাতেই। কিন্তু জয়রামবাটিতে আমাদের মা যে মেয়ের মতোন, তাই গিরিশচন্দ্র যখন অনেক দিন পর জয়রামবাটিতে মাকে প্রণামকালে মায়ের মুখের দিকে তাকান, আঁতকে ওঠেন তিনি। ‘একী! এ তো সেই কালীঘাটের দেবীমূর্তি, যা আমার অবচেতন মনের আকাশে এখনও সমুজ্জ্বল।’ প্রথমে মায়ের সামনে কিছু বলতে না পারলেও ব্রহ্মচারীদের দিয়ে বার বার বলে পাঠান, এই মা-ই কালীঘাটের মা কিনা! তিনি তাঁর সেই স্বপ্নদর্শনের কথা জানান এবং মায়ের সমর্থন পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় থাকেন যে মা কখনও তাঁকে রক্ষা করেছিলেন কিনা? একাধিক বার প্রশ্ন করার পর মা উত্তর দেন, ‘হ্যাঁ, আমিই।’ তিনি তখন উৎকণ্ঠায়, আবেগে-আধ্যাত্মিকভাবে আপ্লুত হয়ে মায়ের কাছে ছুটে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তুমি কী রকমের মা? তুমি যে সেই কবে থেকে আমায় রক্ষা করে চলেছ’। তাঁর এই প্রশ্নের উত্তরে সারদা বললেন, ‘আমি সত্যিকারের মা, কথার কথা মা নই,পাতানো মা নই, আমি সত্য জননী।’
ঠিক একই রকমের অভিজ্ঞতা হয়েছিল স্বামীজির জীবনেও। যে কালীঘাটের মায়ের কাছে মানত করে সুস্থ হয়েছিলেন ছোট্ট নরেন, সেই কালীকেই নানারূপে আবিষ্কার করেছেন বিবেকানন্দ। রামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে ভবতারিণীর ছোঁয়া মিললেও কালীঘাটের কালীর যোগও ভুলে যাননি বিবেকানন্দ। কখনও গিরিশের সাধনালগ্নেও খুঁজেছেন মায়ের গুণ। ‘জ্যান্ত দুর্গা’ সারদার মধ্যেও তন্ন তন্ন করে অনুভব করেছেন কালীঘাটের কালীর কথা। যা গিরিশের জীবনেও ঘটেছে। স্বামীজির নীতি, আদর্শের ভিন্নতা। তাঁর ধর্মচিন্তা, বহুবিধের মিলনের আঙ্গিকে গড়ে ওঠা বিশ্বাসেও কলকাতার প্রাচীন কালী জড়িয়ে রয়েছেন নিরন্তর। জনশ্রুতি, গিরিশের কাছে কালীঘাট মন্দিরের কথা শুনতেন বিবেকানন্দ। কখনও কখনও ভক্তের প্রাচুর্যের মধ্যেই কালীর আবার ভেদ কীসে! একথা বলেই কালীঘাটের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন স্বামীজি। যা বিবেকানন্দ ইতিহাসের ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে রয়েছে আজও।
(লেখক পরিচিতি- অধ্যাপক এবং বিবেকানন্দ গবেষক।)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.