দিব্যেন্দু মজুমদার: হুগলির ত্রিবেণীতেও কুম্ভস্নান। বাংলার ত্রিবেণীও যেন আগেকার এলাহাবাদের সংস্করণ। মাঘী পূর্ণিমায় প্রায় ৭১৩ বছর বাদে ফিরে এল সেই এক ছবি। অন্তঃসলিলা এক ও প্রবহমান দুই নদীর মিলনস্থলে সেই একইরকম পুণ্যডুব। সেই একইরকম সাধু সমাহার। যেন ফিরে এল সাত দশক আগের ছবি।
এলাহাবাদের প্রয়াগের পর হুগলির ত্রিবেণীর মুক্তবেণী ছিল একসময় আধ্যাত্মিক আলোচনার কেন্দ্রস্থল। আর সেই সময় ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাধুসন্তরা মগরার ত্রিবেণীর মুক্তবেণীতে ছুটে আসতেন তাঁদের মোক্ষ লাভের উদ্দেশে। আজ থেকে প্রায় ৭১৩ বছর আগে মাঘ মাসের সংক্রান্তি তিথিতে ত্রিবেণীতে কুম্ভস্নান উপলক্ষে ভিড় জমাতেন সাধুরা। সেই সময় নিয়ম করে এই কুম্ভস্নানের আয়োজন হত। কিন্তু পরবর্তীকালে সেই কুম্ভস্নান বন্ধ হয়ে যায়। এ নিয়ে সাধুসন্তরাও রীতিমতো আক্ষেপ করতেন। ইতিহাস ও তথ্য বলছে, ১৩০৯ সালে শেষবার মাঘী পূর্ণিমায় হয়েছিল কুম্ভস্নান। সেবারই দেশের নানা প্রান্তের সাধুরা জমায়েত হয়েছিলেন তিন নদীর সংযোগস্থলে। ত্রিবেণী যেন বর্তমান প্রয়াগরাজেরই সংস্করণ।
পরবর্তীকালে বিভিন্ন মহল থেকে সাধুসন্তরা এই কুম্ভস্নান নিয়ে বাঁশবেড়িয়া পুরসভার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বাঁশবেড়িয়া পুরসভা বিষয়টির সত্যতা বিচারের জন্য ইতিহাস ঘেঁটে দেখে। এবং তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছয় যে, এই ত্রিবেণীর মুক্তবেণীতে কুম্ভস্নান বহু আগে প্রচলিত ছিল। এরপরই পুরসভার পক্ষ থেকে এক বছর ধরে এই কুম্ভস্নানের আয়োজনের প্রস্তুতি চলতে থাকে। রবিবার সূর্যোদয়ের পর সেই পুণ্য লগ্নের আগমন। আর সেই পুণ্য তিথিতে এদিন ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাধু-সন্ন্যাসীরা কুম্ভস্নানের জন্য ত্রিবেণীতে এসে হাজির হয়ে এক নতুন ইতিহাস রচনা করলেন। আর এই কুম্ভস্নান উপলক্ষে শনিবার থেকেই সাধুসন্তরা পূজাপাঠ—অর্চনা শুরু করেছিলেন। রবিবার শেষ দিন কাকভোরে পুণ্য লগ্নে সাধুরা ত্রিবেণীর মুক্তবেণীতে কুম্ভস্নান সেরে পুজোপাঠ করেন। মগরা থানার পুলিশ ও বাঁশবেড়িয়া পুরসভা তত্ত্বাবধানে এই কুম্ভস্নানের সমস্ত ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন হয়।
হুগলির ইতিহাসবিদ সপ্তর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, এলাহাবাদের প্রয়াগে গঙ্গা, যমুনা যুক্ত হয়েছে এবং সরস্বতী সেখানে অন্তঃসলিলা। আর হুগলির ত্রিবেণীতে গঙ্গা, সরস্বতী মুক্ত হয়েছে এবং যমুনা এখানে অন্তঃসলিলা। তাই এই জায়গার নাম মুক্তবেণী। তিনি বলেন আজ থেকে প্রায় সাড়ে সাতশো বছর আগে এলাহাবাদের প্রয়াগের মতোই ত্রিবেণীতে কুম্ভ স্নানের জন্য সাধু-সন্ন্যাসীরা ছুটে আসতেন। কিন্তু সেই সময় সপ্তগ্রাম ছিল ভারতবর্ষের একটি অন্যতম বাণিজ্য বন্দর। এই বন্দরকে কেন্দ্র করে তখন সারা ভারতবর্ষের অর্থনীতির উন্নয়ন অনেকটাই দাঁড়িয়ে ছিল। পাশাপাশি সপ্তগ্রামের ত্রিবেণী ছিল হিন্দু ধর্মের ও আধ্যাত্মবাদের পীঠস্থান। এই ব্যবসার কেন্দ্রস্থল দখলের জন্য ইং ১২৯৮ খ্রিস্টাব্দে পাঠানরা সপ্তগ্রাম আক্রমণ করে দখল নেয়। পাঠানরা সপ্তগ্রাম দখলে নেওয়ার পর থেকেই ধীরে ধীরে লোপ পেতে থাকে হিন্দু ধর্মের আচার-আচরণ, ধর্মীয় রীতিনীতি, সংস্কার, সংস্কৃতি এবং সেই সময় থেকেই বন্ধ হয়ে যায় পবিত্র এই কুম্ভস্নান। বাঁশবেড়িয়া পুরসভার বিদায়ী ভাইস চেয়ারম্যান অমিত ঘোষ জানান, তাঁরা ইতিহাস ঘেঁটে এর সত্যতা বিচার করে এই কুম্ভস্নানকে ফিরিয়ে আনার জন্য সমস্ত রকম আয়োজন করেছেন। তিনি জানান, এবছর হরিদ্বার, এলাহাবাদ ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ৩০০ সাধু এই কুম্ভস্নান উপলক্ষে এসেছেন ত্রিবেণীতে। আগামী দিনে এলাহাবাদ প্রয়াগের মতো কুম্ভস্নানের জন্য ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাধুসন্ত ও সাধারণ মানুষ এখানে জমায়েত হবেন বলে মনে করেন তিনি। তবে ত্রিবেণী সঙ্গম এদিন সাধুসন্ত পুণ্যার্থীদের আগমনে রীতিমতো জমজমাট হয়ে উঠেছিল।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.