বিশ্বদীপ দে: ভারতবর্ষ এক প্রাচীন দেশ। এদেশের পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি আজও সেই ফেলে আসা সময়ের জলছাপ শরীরে ধারণ করে রেখেছে। আবার সেই সব প্রাচীনতার সঙ্গে বহু সময়ই যুক্ত হয়ে গিয়েছে আশ্চর্য সব মিথ। সেই তালিকায় বেশ উপরের দিকেই থাকবে কাকনমঠ মন্দির। মধ্যপ্রদেশের (Madhya Pradesh) মোরেনা জেলার সিহোনিয়া শহরে অবস্থিত এই মন্দিরকে ঘিরে বিস্ময়ের অবধি নেই। এই শিবমন্দির নাকি তৈরি করেছিল ভূতপ্রেতরা! আর সেটাও এক রাত্তিরে!
মাটি থেকে প্রায় ১১৫ ফুট উঁচু এই মন্দিরটির বয়স নাকি হাজার বছরেরও বেশি। সুউচ্চ মন্দিরটি তৈরি হয়েছে পাথরের উপরে পাথর সাজিয়ে। ব্যবহার করা হয়নি কোনও সিমেন্ট, চুন! আর এরপরও সেই নির্মাণ একেবারে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এতগুলো বছর ধরে। অথচ আশপাশের মন্দিরগুলো ভেঙে গিয়েছে একে একে। কিন্তু কাকনমঠ অটুট না থাকলেও টিকে রয়েছে শক্তিশালী এক নিদর্শন হিসেবে!
আসলে এই মন্দির তো মানুষ বানায়নি। বানিয়েছে ভূতেরা! লোকশ্রুতি যে তেমনই। রহস্যের এমন পরত কাকনমঠ মন্দিরকে আজও পর্যটকদের কাছে তুমুল আকর্ষণীয় এক কেন্দ্র করে রেখেছে। আরও আশ্চর্যের, যে পাথর দিয়ে এই মন্দির নির্মিত সেসবও নাকি কাছাকাছি পাওয়া যায় না। অনেকের এক্ষেত্রে মনে পড়ে যেতে পারে পিরামিডের কথাও। মিশরের মরুভূমিতে অত বড় বড় পাথর কী করে আনা হয়েছিল তা নিয়ে আজও চর্চা অব্যাহত। এক একটি পাথরের ওজন ছিল এক টন বা তারও বেশি! কী করে তা আনা হল সেই রহস্যের কথা মনে পড়ে যায় কাকনমঠ মন্দিরের প্রসঙ্গে কথা বলতে বসলে।
আর একটা আকর্ষণ অবশ্যই এর নির্মাণ কৌশল। এত শত বছরে কত প্রবল ঝড়-ঝঞ্ঝা হয়েছে। কিন্তু কাকনমঠের মন্দিরকে (Kakanmath Mandir) নড়াতে পারেনি। অথচ মন্দিরের পাথরগুলি তো স্রেফ একটার উপরে আর একটা, এইভাবে রাখা! চুন-সিমেন্ট জাতীয় কোনও পদার্থেরই বালাই-ই নেই। বলা হয়, মন্দিরের ভিতরে এমন কোনও শক্তি রয়েছে যা ওই মন্দিরকে আজও আধুনিক পৃথিবীর বুকে টিকিয়ে রেখেছে অক্লেশে। মন্দিরের ঠিক মাঝখানে রয়েছে এক শিবলিঙ্গ (Shiva Linga)। সেই শিবলিঙ্গ, মন্দিরের গর্ভগৃহ কিংবা চূড়া আজও অবিকৃতই রয়েছে। তবে কিছু অংশ কালের নিয়মে খসে পড়েছে বটে। সেগুলি গোয়ালিয়রের একটি জাদুঘরে রাখা হয়েছে।
মন্দিরের সিঁড়ির পাশে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া মন্দিরটির ইতিহাস সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করে রেখেছে। কিন্তু সেইটুকু ইতিহাসের চেয়ে ঢের বেশি আকর্ষণীয় একে ঘিরে থাকা মিথ। রানি কাকনবতীর নামে এই মন্দির। কিন্তু কাকনবতীই এই মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত নন ইতিহাসবিদরা। যাই হোক, মিথ বলছে, কাকনবতী ছিলেন শিবভক্ত। আর তাই তিনি এই শিবমন্দির নির্মাণ করিয়েছিসেন। তবে মন্দিরের নির্মাতা হিসেবে উঠে আসে কচওয়াহা রাজবংশের রাজা কীর্তি রাজের নামও। একাদশ শতকে নির্মিত মন্দিরটি কালের নিয়মে হাজার বছর পেরিয়ে এসেছে।
এবার আসা যাক মন্দির তৈরির সেই মিথের দিকে। বলা হয় এক ফাঁকা স্থানে আচমকাই এক রাতে ভূতপ্রেতের দল পাথর এনে মন্দিরটি তৈরি করে দিয়েছিল। কিন্তু যেহেতু সকাল হওয়ার আগে কোনও মানুষ ঘুম ভেঙে সেখানে উপস্থিত হয়ে গিয়েছিল তাই ভূতেরা মন্দিরটি অসমাপ্ত অবস্থায় রেখেই চলে যায়। আবার আর একটি বিশ্বাস বলছে, আসলে রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে গিয়েছি কাজ শেষ হওয়ার আগে। তাই তা অসমাপ্ত রেখেই শূন্যে মিলিয়ে যায় ভূতের দল! যদিও স্বাভাবিক ভাবেই এমন মিথকে মানতে রাজি নন পুরাতত্ত্ববিদরা। কিন্তু সাধারণ মানুষ যে এমন রহস্যময় গল্পের সন্ধান পেলে তাকে বিশ্বাস করে ফেলেন মুহূর্তে তা তো বলাই বাহুল্য। অনেকের দাবি, এর আসল কৃতিত্ব মন্দির নির্মাণের দায়িত্বে থাকা শিল্পীরা। তাঁরাই এমন অতুলনীয় ভারসাম্যে পাথরগুলিকে সাজিয়েছিলেন যা আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে। তবে মন্দিরটির দিকে তাকালে মনে হবেই, এটি অসম্পূর্ণ। আর তখনই আপনার মাথায় খেলে যাবে নিশুতি রাতে ‘তেনাদের’ হাতে মন্দির তৈরির সেই রোমাঞ্চকর গাথা।
এদিকে এই মন্দির ঘিরে রয়েছে অন্য এক ইতিহাসও। বলা হয়, মুসলিম শাসকরা এই মন্দির ভাঙার চেষ্টা করেছিলেন। রীতিমতো কামান দেগেছিলেন। কিন্তু কাকনমঠ মন্দির থেকে গিয়েছিল যেমন ছিল তেমনই। তবে কিছু পাথর ভেঙে পড়েছিল। সেই সব ভাঙা পাথর আজও মন্দিরে বেড়াতে গেলে দেখতে পাওয়া যায়। সেখানেও আবার রয়েছে মিথ। বলা হয়, মন্দির প্রাঙ্গণের পাথরকে কেউ যদি তুলে নিয়ে যায়, তাহলে মন্দিরের অন্য পাথরগুলোতেও যেন কম্পন দেখা দিতে থাকে! ফলে যে নিয়ে যায় সে আবার গুটিশুটি মেরে তা ফিরিয়েও দিয়ে যায়!
মন্দিরকে ঘিরে গা ছমছমে সব মিথ একে আজও রহস্যের কুয়াশায় মুড়ে রেখেছে। আজ আর এই মন্দিরের কোনও পুরোহিত নেই। তবে এএসআইয়ের রক্ষী থাকেন। তবে কেউই রাতে থাকেন না। রাত হলেই তাঁরা আশ্রয় নেন নিকটবর্তী গ্রামে। রাতের অন্ধকারে একা একাই থাকে কাকনমঠ মন্দির। তার শত শত বছরের স্মৃতিমাখা পাথরের গায়ে ইতিহাসের ছায়া পড়ে। প্রশ্নগুলো জেগে থাকে। কেমন করে তৈরি হয়েছিল এই মন্দির? কী করে তা আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে অবিকল? প্রশ্নগুলো শুনতে সহজ মনে হলেও উত্তরগুলো আজও জানা যায়নি। হয়তো কোনওদিনই জানা যাবে না। কেবল গা ছমছমে কুয়াশার ভিতরে অবিকল থেকে যাবে মিথগুলো।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.