ক্ষীরোদ ভট্টাচার্য: হতে পারে কাকতালীয়। কিন্তু এটাই ঘটনা। করোনা আবহে টানা ১৪ দিন নিভৃতবাস বা কোয়ারেন্টাইনে থাকবেন দারুব্রহ্ম জগন্নাথদেব। একইসঙ্গে জ্বরে আক্রান্ত হবেন বোন সুভদ্রা, দাদা বলরামও। হাজার বছর ধরে পৃথিবীর সমস্ত জগন্নাথের মন্দির এই নিয়ম নিষ্ঠার সঙ্গে পালন হয়ে আসছে। তবে করোনা আবহে এই চিরকালীন প্রথা নিঃসন্দেহে বিশেষ মাত্রাবাহী।
ঈশ্বরের দৃষ্টান্ত খাঁড়া করে মনুষ্যকুলের একাংশের অবিমৃশ্যকারিতার প্রতি তোপ দেগেছেন অনেকেই। ইসকন, মায়াপুর তো বটেই, মাহেশ বা গুপ্তিপাড়ার সব ভক্ত, সেবাইত একযোগে প্রশ্ন তুলেছেন, স্বয়ং জগন্নাথ যদি শরীর খারাপ হওয়ায় ১৪দিনের জন্য নিভৃতবাসে থাকতে পারেন, জাগতিক কোলাহল থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারেন, তাহলে মানুষ কেন পারবে না? লকডাউন ও কোয়ারেন্টাইন ঠিকঠাক মেনে চলতে বাধা কোথায়? আর কেনই বা চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলবে না?
আগামী ৫ জুন। বাংলা পঞ্জিকামতে ২২ জ্যৈষ্ঠ, মহাপ্রভুর জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা। জ্যৈষ্ঠ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে শাস্ত্র মেনে কলসি কলসি জল ও অন্যান্য উপাচার দিয়ে স্নান করানো হবে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রাকে। তারপর শরীর ক্রমশ খারাপ হতে শুরু করবে দারুব্রহ্মের। ব্যস, বিকেল থেকেই গা গরম। সন্ধ্যা হলেই জ্বরে কম্পমান স্বয়ং ঈশ্বর। একই অবস্থা ভাইবোনেরও। ইসকনের কলকাতা শাখার সহ-সভাপতি তথা মুখপাত্র রাধামোহন দাসের কথায়, ”রাতে জ্বর এতটাই বাড়ে যে কাঁথা-কম্বল চাপা দিতে হয় জগন্নাথকে। মূল মন্দির থেকে বিগ্রহকে নিয়ে যাওয়া হয় সিক রুমে। যে ঘরে একটি মাত্র দরজা, কোনও জানলা নেই।” মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরের প্রধান সেবাইত সৌমেন অধিকারী জানাচ্ছেন, ”ফি বছর দু সপ্তাহ স্বয়ং ভগবান জগন্নাথদেব নিভৃতবাসে থাকেন। কবিরাজরা তাঁর শরীরের অবস্থা বুঝে ওষুধের মাত্রা ঠিক করেন।”
হিন্দুশাস্ত্রের স্কন্দপুরাণে এই ১৪ দিনকে ‘অনবসর’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই দিনগুলোয় জগন্নাথদেব লোকচক্ষুর আড়ালে থাকবেন। মন্দিরে পুজো হবে না। সহ-দেবতাদের পুজো হবে। তবে জগন্নাথদেবের জন্য কাঁসর-ঘণ্টাও বাজবে না। এমনকী ছাপ্পান্ন ভোগও দেওয়া হবে না। এই কদিন জগন্নাথদেবের জন্য বরাদ্দ হবে হালকা ফল ও পথ্য, বিভিন্ন ঔষধি আর জড়িবুটির পাঁচন। টানা চোদ্দদিন এই নিয়ম কঠোরভাবে পালন করবেন জগন্নাথদেব। মন্দিরে এই কদিন বিভিন্ন বিখ্যাত কবিরাজ আসেন। তাঁরাই পথ্য আর পাঁচন দিয়ে পরিচর্যা করে সুস্থ করে তোলেন মহাপ্রভু জগন্নাথকে। একইরকম ব্যবস্থা মাহেশেও। বৈদ্যবাটি, আরামবাগ, বর্ধমানের বিখ্যাত কবিরাজরা নিজেরাই জড়িবুটি, পাঁচন তৈরি করে জগন্নাথদেবকে নিবেদন করেন। রাজবৈদ্যদের ওষুধ আর সেবাযত্নে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন জগন্নাথ। ৬২৪ বছর ধরে এই নিয়ম পালিত হচ্ছে মাহেশ ও ইসকনের মন্দিরে।
করোনা সংক্রমণ ও লকডাউনের জন্য এবারের স্নানযাত্রা অন্য মাত্রা পেয়েছে। সব নিয়ম পালন করা হবে। স্বয়ং জগন্নাথদেব দাদা ও বোনকে নিয়ে নিভৃতবাসে থাকবেন। কিন্তু আমরা কেন এই সংক্রমণকে লঘু করে দেখছি? প্রশ্ন তুলছেন ইসকন-সহ অধিকাংশ মন্দিরের সেবাইতরা। যেমন রাধারমণ দাসের কথায়, ”বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই আশঙ্কাপ্রকাশ করেছেন যে জুন-জুলাই মাসে করোনা সংক্রমণ আরও ভয়াবহ আকার নেবে। এখনই দেশের ৮০ হাজার মানুষ আক্রান্ত। প্রতিদিনই সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ছে। এই ভয়াবহ আবহ থেকে মুক্তি পেতে চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা যেসব নির্দেশ দিচ্ছেন, তা অক্ষরে অক্ষরে মানতেই হবে। আমাদের কোয়ারেন্টাইন এবং লকডাউন মানতে হবে। ”
জগন্নাথগদেবের এই নিভৃতবাস আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে আনছে। তা হল, শরীর বা পরিবেশ অস্থির কঠোর নিয়ম ও অনুশাসন মেনে চলতে হয়। ঈশ্বর যদি নিজেই নিয়ম মেনে চলেন, তবে মানুষের সমস্যা কোথায়? সৌমেনবাবুর বক্তব্য, ঈশ্বর যদি কোয়ারেন্টাইন মেনে সুস্থ হতে পারেন, তাহলে আমাদের কোথায় সমস্যা? তিনিই তো নিয়ম মানার পথ বাতলে দিয়েছেন। মাহেশের রথযাত্রা এবার হবে কি না, তা নিয়ে ২০ মে আলোচনায় বসবে হুগলি জেলা প্রশাসন। তবে পরিস্থিতি কেমন থাকে, তার উপরেই সবটা নির্ভর করবে বলে জানিয়েছেন সৌমেনবাবু।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.