কালীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়: অন্নদাত্রী দেবী অন্নপূর্ণা। দেবী দুর্গার আরেক রূপভেদ। দেবী দ্বিভূজা, গাত্রবর্ণ ঈষৎ রক্তাভ। স্তনভারনম্রা। দেবীর বামহাতে থাকে সোনার অন্নপাত্র। ডানহাতে দর্বী অর্থাৎ চামচ বা হাতা। মাথায় বিরাজিত অর্ধচন্দ্র। তিনি ক্ষুধার্ত মহাদেবকে অন্নদান করছেন স্মিতহাস্যে। পুরাণ মতে চৈত্রমাসে শুক্লা অষ্টমী তিথিতে কাশীতে আভির্ভূতা হয়েছিলেন দেবী। সেই সূত্রে এই তিথিতে দেবী অন্নপূর্ণার বাৎসরিক পুজো (Annapurna Puja)। আগমবাগীশের তন্ত্রসার গ্রন্থে অন্নপূর্ণা পুজোর বিশদ বিবরণ রয়েছে। অন্নদার মাহাত্ম্যগাথা নিয়ে রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রচনা করেছিলেন ‘অন্নদামঙ্গলকাব্য’।
লৌকিক মতে, দেবী অন্নপূর্ণার পুজো বঙ্গদেশে প্রচলন করেছিলেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের (Krishna Chandra Ray) পূর্বসুরী ভবানন্দ মজুমদার। দেবী অন্নদার কৃপা প্রাপ্ত হয়ে ভবানন্দ মজুমদার জাহাঙ্গীরের কাছে রাজা উপাধি লাভ করেছিলেন। কিন্তু অন্নদামঙ্গলকাব্যে দেখি, নবাব মুর্শিদকুলি খাঁয়ের (Murshidkuli Khan) কাছে নির্ধারিত দিনে কর বা রাজস্ব মেটাতে না পেরে দুর্গাপুজোর সময় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র মুর্শিদাবাদে কারারুদ্ধ হন। সেই সময়ে দেবী অন্নপূর্ণা রাজাকে দর্শন দিয়ে তাঁর মূর্তি পুজো করতে বলেছিলেন। নদিয়াধিপতি কৃষ্ণচন্দ্র অন্নপূর্ণার পূজা প্রসারে যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন তা অনস্বীকার্য। তবে তা মূলত সীমাবদ্ধ ছিল জমিদারমহলে ও ধনাঢ্য পরিবারে।
অন্নপূর্ণা পুজো বাংলার একটি প্রাচীন পুজো। এই পুজো এসেছিল কাশী থেকে। বাংলার সঙ্গে কাশীর যোগ বহুকালের। বাঙালির কাছে গয়া-কাশী-বৃন্দাবনের ভূমিকা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। বারাণসী শুধু বাবা বিশ্বনাথের ধাম নয়। বাঙালির বার্ধক্যের কাশী। সেকালে অধিকাংশ ধার্মিক ধনাঢ্য পরিবারের বিধবারা কাশীবাসী হতেন। আর এই কাশী হল মা অন্নপূর্ণার অধিষ্ঠানক্ষেত্র। শৈব ও শাক্ত-সংস্কৃতির অপূর্ব মিলনস্থল।
মার্কেণ্ডেয় পুরাণের কাশীখণ্ড দেবীভাগবতে ও অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থাদিতে কাশীর অন্নপূর্ণা সম্পর্কে নানা উপাখ্যান রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাশীপ্রতিষ্ঠার কাহিনি। লোককাহিনি অনুসারে, শিব যোগীরাজ হলে কী হবে আদতে ভিক্ষুক। রোজগারের মুরোদ নেই। রাজার দুলালী গৌরীর তাই একেবারে হাঁড়ির হাল। এই নিয়ে অহরহ শিব-দুর্গার কলহ। ক্ষোভে দুঃখে গৌরী একদিন চলে গেলেন বাপের বাড়ি। জয়া-বিজয়া তাকে পরামর্শ দিলেন যে ভিখিরি শিবকে জব্দ করতে হবে। সেই মোতাবেক দেবী জগতের সমস্ত অন্ন হরণ করলেন। শিব তখন খিদের চোটে নাকাল। যেখানেই যান হা অন্ন! হা অন্ন! শেষে লক্ষ্মীর পরামর্শে কাশীতে এলেন শিব। অন্নপুর্ণার হাত থেকে অন্ন খেয়ে পরিতৃপ্ত হলেন। কাশীতে স্বয়ং মহাদেবের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হল দেবী অন্নপূর্ণার মন্দির। চৈত্র শুক্লাষ্টমীতিথিতে শুরু হল দেবীর পুজো। এইভাবে কালক্রমে কাশীর দেবী অন্নপূর্ণা হয়ে উঠলেন বাঙালির ঘরের মেয়ে।
তবে পুরাণ কাহিনি থেকে জানা যায় কাশীতে অন্নপূর্ণা প্রতিষ্ঠিতা হয়েছিলেন। আগে এই পুজো কাশীতে হতো না। এখন প্রশ্ন হল, আদিতে তা হলে অন্নপূর্ণা কোথায় পূজিতা? আসলে অন্নপূর্ণা শস্যদেবী। পেটের জ্বালা বড়ো জ্বালা। জনশ্রুতি হল এই দেবীর পুজো করলে অন্নকষ্ট দূর হয়। আমাদের সমাজ জীবনে মাঝে মাঝেই নেমে আসে আকাল বা দুর্ভিক্ষের অশনিসংকেত। তার বলি হয় গরিব মানুষই। সুপ্রাচীন কাল থেকেই রাঢ় বাংলায় নবান্ন উৎসবের সময় এই অন্নপূর্ণার পুজো হয়ে আসছে। আজও গ্রামে গ্রামে নতুন ফসল তোলার পরই দেবীর হাতে ধানের পাকা শিষের গুচ্ছ দিয়ে পুজো হয়। কাশীর অন্নপূর্ণার সঙ্গে যার গভীর মিল রয়েছে। কাশীর মন্দিরেও শুধু পাকা ধানের গুচ্ছ বা শষ্য দিয়ে দেবীর পুজো-অর্চনা হয়। সুতরাং কোনও সন্দেহ যে, নেই দেবী অন্নপূর্ণা মূলত রাঢ়-বঙ্গের দেবী। এক সময় এই দেবীর পুজো কাশীতে নিয়ে গিয়েছিলেন বাঙালিরাই।
আচার্য সুকুমার সেনের মতে দেবী অন্নপূর্ণা গ্রিক ও রোমান দেবী ‘অন্নোনা’র রূপান্তর। খ্রিস্টিয় প্রথম শতকের রোম সম্রাট টিটাসের রাজত্বকালে্র একটি মুদ্রায় এই অন্নোনার মূর্তি খোদিত আছে। দেবীর বামহাতে শিঙ্গা আর ডানহাতে তুলাদণ্ড। অনেকেই অবশ্য আচার্য সেনের এহেন অভিমত মেনে নিতে পারেননি। তাঁদের মতে এই শস্যদেবী আসলে শাকম্ভরীর মতো একান্তই ভারতীয় দেবী, যার উৎস রয়েছে হরপ্পা (Harappa Civilisation) সভ্যতায়। একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, ভারতীয় অন্নপূর্ণার সঙ্গে গ্রিক রোমান অন্নোনার মিল আসলে এই শষ্যদেবীর পৌরাণিকতাকেই স্বীকৃতি দিচ্ছে। বঙ্গদেশে সাধারণ মানুষ অন্নপূর্ণার পুজো করেন অগ্রহায়ণ মাসের নবান্নের সময়। এটি প্রাচীন পুজো যা পরবর্তীকালে কাশীতে অনুপ্রবেশ করেছিল প্রবাসী বাঙালিদের হাত ধরেই।
এ দিকে কাশী প্রত্যাগত অর্বাচীন অন্নপূর্ণা পুজো চৈত্রমাসের শুক্লাষ্টমী তিথিতে হয় মূলত জমিদার বা বনেদি বাড়িতে। পুজো হয় শাক্তমতে। নবান্নের সময় এই অন্নপূর্ণা পুজোয় আদৌ বলি বা ষোড়শোপচারে পূজা হয় না। মূলত শ্রমজীবী মানুষেরাই এই দেবীর পুজো নিয়ে আসেন। অন্যদিকে চৈতি অন্নপূর্ণার পুজো বনেদি বাড়িতে বা জমিদার মহলের। অন্নপূর্ণার প্রাচীন মন্দির বলতে ব্যারাকপুরে রয়েছে। রানি রাসমণির কন্যা জগদম্বা এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। শেওড়াফুলি রাজবাড়িতেও অন্নপূর্ণা দেবী পূজিত হন। এ ছাড়া কলকাতা ও অন্যান্য স্থানে সাবেকি পুজো হয়ে আসছে। মুর্শিদাবাদ জেলার সালার থানার কাগ্রামে জমিদার রায়চৌধুরী পরিবার। দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদার অম্বিকালাল চৌধুরীর স্ত্রী রামাসুন্দরী দেবী।একবার দেবী কর্তৃক স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে অন্নপূর্ণা পূজা এনেছিলেন। সেই পুজো আজও নিয়ম-নিষ্ঠায় জাঁকজমকে চলে আসছে। এ ছাড়াও কলকাতার বিভিন্ন সম্ভ্রান্ত বাড়িতে ঘটা করে দেবী অন্নদার পুজো শুরু হয়েছে৷ যে দেবী অন্ন দান করেন, তাঁর সামনে আজও প্রণত সমস্ত মানুষ। শ্রেণিবিশেষে পুজোর রকসকম বদলে গেলেও, ভক্তির সূত্রে বাঁধা পড়েছেন সকলেই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.