সুকুমার সরকার, ঢাকা: বাংলাদেশের দক্ষিণ জনপদে অবস্থিত সুন্দরবনের অভ্যন্তরে শেখেরটেকে মোগল আমলে নির্মিত হয়েছিল একটি দুর্গ ও মা কালীর মন্দির। সেই দুর্গের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে কালী মন্দিরটি। অনুমানিক ৪০০ বছরের পুরনো মন্দিরটিতে এবারই প্রথম সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাতে স্বভাবতই বেশ খুশি বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা।
বাংলাদেশের (Bangladesh) প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই মন্দির (Hindu Temple) ও দুর্গটি মোঘল আমলে রাজা প্রতাপাদিত্যের সময়ে নির্মিত। দুর্গ ও মন্দিরটি সরকারের বনবিভাগ ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর যৌথভাবে সংস্কার করছে। এতে অর্থায়ন করছে বনবিভাগ। আর কারিগরি সহায়তা করছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। খুলনাঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দে বলেন, ‘‘মন্দিরটির উপরে গাছপালা জন্মেছে। ওই ভারে এটি যে কোনও সময় ভেঙে যেতে পারে। তাছাড়া দেওয়ালেও কোথাও কোথাও ইট খুলে পড়ছে। তাই টেকসইভাবে এটি সংস্কার করা হচ্ছে। সুন্দরবন (Sunderban) সুরক্ষা প্রকল্পের আওতায় এখানে ৭৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। তবে যেহেতু এটি ঐতিহাসিক নিদর্শন, তাই প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কাছ থেকে কারিগরি সহায়তা নিয়ে সংস্কার করা হচ্ছে।’’
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মন্দিরটির স্থাপত্য কাঠামো ও শিল্পশৈলী দেখে অনুমান করা হয়, ৪০০ বছর আগে এটি নির্মিত হয়েছে। এর দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে রয়েছে দু’টি প্রবেশদ্বার। এতে মোট চার ধরনের ইট ব্যবহার করা হয়েছে। মন্দিরের বাইরের দিকে জ্যামিতিক নকশা, ফুল-লতা-পাতা প্রভৃতি সংবলিত পোড়ামাটির অলংকৃত ইট ব্যবহার করা হয়েছে। দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে প্রবলভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরটির অভ্যন্তরের বিভিন্ন স্থানেও ফাটল ধরেছে। বড় বড় গাছের শিকড় প্রবেশ করে মন্দিরের ডোম ও দেওয়ালগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। মন্দিরের চারপাশে বিশেষ করে দক্ষিণ দিকে প্রচুর ছোট-বড় গাছ রয়েছে, যার ছায়ার কারণে মন্দিরে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে না।
প্রত্নতাত্ত্বিকরা বলছেন, মন্দির নির্মাণে স্থানীয় শামুকের তৈরি চুন, মাটি পুড়িয়ে তৈরি করা ইট ও শিবসা নদীর বালি ব্যবহার করা হয়েছিল। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর থেকে সংস্কার কাজটি তদারকি করছেন খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক লাভলি ইয়াসমিন। তিনি বলেন, ‘‘একমাস আগে থেকে আমরা সংস্কার (Renovation) কাজ শুরু করে দিয়েছি। আগে যেসব আকারের ইট ছিল, সেই আকারের ইট তৈরি করে, মন্দিরের আকৃতি অপরিবর্তনীয় রাখা হচ্ছে। দুর্গম এলাকা। বাঘের আধিক্য রয়েছে। বাঘের ভয়ে আমাদের দুই ধাপের শ্রমিকরা সেখান থেকে পালিয়ে চলে এসেছেন। এখন শ্রমিকদের বুঝিয়ে, বন বিভাগের অস্ত্রধারী নিরাপত্তারক্ষী রেখে সংস্কারের কাজ করা হচ্ছে।’’
কালী মন্দির ঘিরে ইতিমধ্যে বনবিভাগ নির্মাণ করেছে শেখেরটেক ইকো টুরিজম কেন্দ্র। যা খুলনা শহর থেকে নদীপথে প্রায় ৮৫ কিলোমিটার দূরে। বনবিভাগ জানায়, ২০২১ সালে সুন্দরবনে নতুন করে চারটি পর্যটন কেন্দ্র তৈরির উদ্যোগ নেয় বনবিভাগ। সেগুলি হলো, সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জের শেখেরটেক ও কালাবগী, শরণখোলা রেঞ্জের আলিবান্ধা ও চাঁদপাই রেঞ্জের আন্ধারমানিক। তবে ঐতিহাসিক নিদর্শন থাকায় সব থেকে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে শেখেরটেক ইকোটুরিজম কেন্দ্রটি। মন্দিরটির সংস্কার একটি ভালো উদ্যোগ বলে জানিয়েছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. ওয়াসিউল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘‘মন্দিরটি ২০ বছর আগে আমি পরিদর্শন করেছি। খুবই ভঙ্গুর দশায় রয়েছে। এটির সংরক্ষণ করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ করা জরুরি ছিল। তবে ওই এলাকার জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি এড়াতে বনবিভাগের আরও সতর্ক হতে হবে। ইতিমধ্যে সেখানে প্রচুর গাছপালা কেটে কংক্রিটের ফুট ট্রেল নির্মাণ করা হয়েছে। বনবিভাগের উচিত, সেখানে সীমিত পরিসরে পর্যটক পাঠানো। কারণ পর্যটনের জন্য বনের পরিবেশ নষ্ট বা বাঘেদের যন্ত্রণা দেওয়া ঠিক হবে না।’’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.