শংকরকুমার রায়, রায়গঞ্জ: সিপাই বিদ্রোহের বর্ষে শুরু হয়েছিল দেবীর আরাধনা। মহালয়ের ভোরে বেদিতে ঘট বসিয়ে দুর্গাপুজোর সূচনা হয়েছিল উত্তর দিনাজপুরের (North Dinajpur) হরিপুরের কুণ্ডু জমিদার বাড়িতে। ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় পুরনো কাঠামোয় নতুন সাজে মন্দিরে অধিষ্ঠিত হয় একচালা দুর্গা প্রতিমা। দুর্গার ডানদিকে গণেশের বদলে কার্তিকের পাশে কলাবউ পূজিত হয় এখানে। মহাষষ্ঠী থেকে দশমী – পুজোয় দেবীর অন্নভোগ সম্পূর্ণ লবণ ও হলুদ ছাড়াই রান্না হয়। মহাঅষ্টমীতে কুণ্ডুবাড়ির দেবীর সামনে মোষ বলি দিয়ে পুজোর সূত্রপাত হয়েছিল। কিন্তু অনেক বছর ধরে মোষ বলি বন্ধ হয়েছে। তবে ঐতিহ্য মেনে সবজি, চালকুমড়ো বটিতে এক কোপে কেটে বলিপ্রথার ধারাবাহিক ঐতিহ্য বজিয়ে রয়েছে। সামগ্রিকভাবে সিপাই বিদ্রোহের সঙ্গে সম্পর্কিত কুণ্ডুবাড়ির দুর্গাপুজোর (Durga Puja 2021) ছবিটা এরকমই।
ইংরেজ আমলে ১৮৫৭ সালে সিপাই বিদ্রোহের (Sepoy Mutiny) বছরে বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার হরিপুরের জমিদার ঘনশ্যাম কুণ্ডু দুর্গাপুজোর সূচনা করেছিলেন। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হতেই ওপার থেকে বিতাড়িত হয়ে এপারের রায়গঞ্জে চলে আসেন রায়চৌধুরী উপাধি পাওয়া এই পরিবার। স্বাধীনতা বছরেই রায়গঞ্জের মোহনবাটি নিশীথ স্মরণীর বাড়িতে পূর্বপুরুষের সাবেকি দুর্গাপুজো নতুন রূপে শুরু করেন নগেন্দ্রবিহারী রায়চৌধুরী। প্রায় পৌনে দু’শো বছরের ঐতিহ্যশালী দুর্গাপুজোর দায়িত্ব এখন বংশপরম্পরায় পরিবারের উত্তরপুরুষদের।
তবে এই বাড়ির দুর্গাপুজোর সূত্রপাতের ঘিরে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। পরিবারের সদস্যদের কেউ জানান, স্বপ্নাদেশ পেয়ে পুজোর প্রচলন হয়েছিল। আবার বংশধরদের একাংশের মত, আসলে ব্রিটিশ রাজত্বে ইংরেজদের নিদারুণ অত্যাচারের হাত থেকে ভারতীয় সিপাইদের রক্ষা করতে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী বাড়িতে দেবী আরাধনা সূত্রপাত হয়। আর ইতিহাসবিদদের মতে, ১৮৫৭ সালে সিপাই বিদ্রোহের শুরুতে দ্রুত শান্তি স্থাপনের উদ্দেশে দেবীবন্দনার সূচনা হয়।
এই সম্ভ্রান্ত পরিবার শাক্য ধর্মে দীক্ষিত ছিলেন। পূজার্চনার আবহে বংশ পরম্পরায় বেড়ে ওঠা। তবে তৎকালীন বাংলাদেশের হরিপুরের ব্যবসায়ী ঘনশ্যাম কুণ্ডুর স্ত্রী অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ছিলেন। কথিত আছে, রুগ্ন সন্তানের স্বাস্থ্য উন্নতির উদ্দেশে দুর্গাপুজোর আয়োজন শুরু হয়েছিল। কুণ্ডু পরিবার পরবর্তীতে ইংরেজদের দেওয়া উপাধি ‘রায়চৌধুরী’ হিসাবে সুপরিচিত লাভ করেন। তারপর থেকে দিনাজপুরের হরিপুর এস্টেট এই পরিবারের অধীন আসে। মহালয়া থেকে বংশপরম্পরায় বাড়িতে নিরামিষ ছাড়া কোনও খাবার বাড়িতে প্রবেশ করত না। লক্ষ্মীপুজো পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিরামিষ খাবার আহার করতেন। এই জমিদার পরিবার বিদেশেও ব্যবসা করতেন। ইংরেজ আমলে জাহাজের বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী রপ্তানি করতেন। বাংলাদেশের সঙ্গে সেইসময় বার্মা ও শ্রীলঙ্কা এবং আফগানিস্তানের সঙ্গেও ব্যবসা ছিল।
শুধু তাই নয়, ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ ছেড়ে এলেও অনেক আত্মীয়স্বজন এখনও ওপারেই রয়ে গিয়েছেন। যদিও নগেন্দ্রবিহারী রায়চৌধুরীর ছেলেমেয়েকে নিয়ে এপাড়ের অবিভক্ত পশ্চিম দিনাজপুরের চলে আসেন। আর সেই বছরই রায়গঞ্জের মোহনবাটিতে দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন। পরবর্তীতে বসতবাড়ির চৌহদ্দিতেই কংক্রিটের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এখন উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জের ধনকৈল হাট এবং কুনোর হাটের মালিক রায়চৌধুরী পরিবার।
রায়গঞ্জের রায়চৌধুরী পরিবারের চার পুরুষ ধরে দুর্গাপুজো হচ্ছে। বর্তমানের পুজোর আয়োজন করেন প্রয়াত রজতেন্দ্রকৃষ্ণ রায়চৌধুরীর স্ত্রী শঙ্করী রায়চৌধুরী। তিনি বলেন,”আমার বয়স বাড়ছে, ফলে এখন আর সেভাবে পুজোর দিকে নজর দিতে পারি না। ছেলে শিবশংকর রায়চৌধুরী পুজো দেখাশোনা করে। তবে পুজোর অষ্টমীতে প্রচুর মানুষজনদের খিচুড়ি প্রসাদ দেওয়া হত। কিন্তু গত বছর করোনার কারণে সেইভাবে প্রসাদ দেওয়া হচ্ছে না।” দশমী পুজোর শেষে বিসর্জনে দেবীপ্রতিমা নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়ে কাঠের কাঠামো তুলে নিয়ে কংক্রিটের ঠাকুর দালালে স্থাপন করা হয়। বংশ পরম্পরায় ওই কাঠামোতেই পরের বছর দেবীর আগমনের প্রস্তুতি শুরু হয়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.