ফাইল ছবি
বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য, শিলিগুড়ি: উমা আসছেন। তিনি ফিরবেন কবে কৈলাসে? বড্ড বোকা বোকা প্রশ্ন মনে হতেই পারে। অনেকে চটপট বলেও বসবেন, কেন দশমীতে। কিন্তু হিসাবে তা বলে না। পাঁজিতেও নির্ঘন্ট মেলে না। কারণ, পরম্পরা ভেঙে দশমীর পরও যে তিনি থেকে যান তিস্তা, তোর্সা, রায়ডাক পাড়ের গাঁয়ে!
ওই উমা ঠিক যেন গাঁয়ের বধূ। তবে মোটেও শান্ত, স্নিগ্ধ নন। রক্তিম বর্ণ। গড়নে মঙ্গোলীয় জনজাতির ছায়া স্পষ্ট। প্রচলিত বিশ্বাস, বারোয়ারি মণ্ডপ থেকে বিদায় নিয়ে পথে চাষির পর্ণ কুটিরে বিশ্রাম নিয়ে তবেই হিমালয়ে ফিরে যান দেবী ঠাকুরানি। তখন তিনি দেবী ভান্ডানী। তাই শরৎ জুড়ে উৎসবের আবহ কিরাত ভূমির পথে প্রান্তরে। এখানে পিতৃপক্ষের অবসান, দেবীপক্ষের সূচনা বলে কিছু নেই। পক্ষ দুটি। সেটি অর্থনৈতিক বিন্যাসের উপরে তৈরি ভিন্ন ধরণের ‘যাত্রা’ ও ‘মাত্রা’। রাজবংশী সমাজের অর্থবান জোতদার শ্রেণির মানুষেরা মহানবমীতে দেবী আরাধনা করতেন। সেটি ‘মাত্রা পক্ষ’ নামে পরিচিত। সাধারণ মানুষ দশমীতে কৃষি বন্দনা দিয়ে দেবী ঠাকুরানিকে পুজো দেন। পোশাকি নাম ‘যাত্রা পক্ষ’।
কোথাও মহানবমী আবার কোথাও দশমীতে কৃষি সামগ্রীর পুজোর আয়োজন হয়ে থাকে রাজবংশী অধ্যুষিত উত্তরের গাঁয়ে। শুরু হয় হেমন্তের কৃষি কাজের প্রস্তুতি। মূলত একাদশী তিথি থেকে তিস্তাপাড় মেতে ওঠে দেবী ভান্ডানী আরাধনায়। প্রচলিত বিশ্বাস, দেবী ঠাকুরাণি দশমীর পর পুজো নিতে আবির্ভূত হন অন্য রূপে। তখন তিনি দেবী ভান্ডানী। যদিও গবেষক মহলের দাবি, ভান্ডানী আদতে কৃষির দেবী। ‘ভান্ডার’ শব্দ নামকরণের উৎস। তিনি শস্য ও প্রাচুর্যের দেবী। আদতে দেবী ঠাকুরানি অর্থাৎ উমাকে নিয়ে উত্তরে যত গল্পগাঁথা প্রচলিত হোক না কেন, সেটা খুব বেশি দিনের নয়। কারণ, তিস্তা, তোর্সা, সংকোশ নদীপাড়ের সমাজে দেবী দুর্গা আরাধনার রেওয়াজ পাঁচশো বছরের বেশি প্রাচীন নয়, এমনটাই বলছে গবেষণা।
বাংলায় কবে নাগাদ দুর্গা পুজোর সূচনা এবং সেটা কে করেন, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। গবেষকদের একাংশ মনে করেন, ষোড়শ শতকের শেষ ভাগে রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণ বাংলায় দুর্গা পুজোর সূচনা করেন। আবার অনেকেরই দাবি, মনু সংহিতার টীকাকার কুলুক ভট্টের পিতা উদয় নারায়ণই প্রথম দুর্গাপুজো করেন। পৌত্র কংস নারায়ণ সেটা অনুসরণ করেছেন মাত্র। ইতিহাসবিদের মতে, ১৬০৬ খ্রীস্টাব্দে নদিয়ারাজ ভবানন্দ মজুমদারের ভদ্রাসনেই প্রথম অনুষ্ঠিত হয়েছিল দুর্গা পুজো। বঙ্গদেশে মূলত মহিষাসুরমর্দিনীর পুজো দুর্গাপুজো হিসাবে প্রচলিত। আনুমানিক অষ্টম শতাব্দীতে রচিত ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে মহিষাসুরমর্দিনী আরাধনার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়াও দুর্গাপূজার উল্লেখ রয়েছে মার্কণ্ডেয় পুরাণে। সেখানে রাজা সুরথের বসন্ত ঋতুতে দেবী দুর্গার মৃন্ময়ী প্রতিমার পুজো করবার কথা রয়েছে। তবে বঙ্গদেশে দেবী আরাধনার সূচনা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও আদিতে কিরাত ভূমি নামে পরিচিত উত্তরে হৈমবতী আরাধনার সূচনা নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই।
ইতিহাস গবেষক আনন্দগোপাল ঘোষ বলেন, “উত্তরে দেবী আরাধনার স্রষ্ঠা হিসাবে দু’টি নাম উঠে আসে। তাঁরা হলেন, কোচবিহার রাজতন্ত্রের জনক বিশ্বসিংহ এবং তাঁর যোগ্যতম পুত্র নরনারায়ণ। এরপর ওই রাজ পরিবারের হাত ধরে দেবী উমা ধীরে ধীরে গাঁয়ের সাধারণ মহলেও পরিচিত হয়ে উঠতে শুরু করেন।” এর আগে তিস্তা, তোর্সা, রায়ডাক, জলঢাকা পাড়ের ভূমিপুত্র রাজবংশী, মেচ, রাভা সহ অন্য মঙ্গোলীয় বংশদ্ভুত সর্বপ্রাণবাদী সমাজে পার্বতী অপরিচিতই ছিলেন। রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান তথা লোকসংস্কৃতি গবেষক দীপক রায় বলেন, “উত্তরে দুর্গা পুজোর প্রচলনের মধ্যে জড়িয়ে ছিল ব্রাহ্মনায়ণের প্রক্রিয়া। কালক্রমে পরিবর্তন এতটাই হয়েছে যে আদিতে ব্যাঘ্র বাহিনী ভান্ডানী সিংহবাহিনী হয়ে দশভূজার প্রতিরূপ কল্পিত হয়েছে। যাত্রা ও মাত্রা গুরুত্ব হারিয়েছে।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.