সুরজিৎ দেব, ডায়মন্ড হারবার: আবহাওয়া জানান দিচ্ছে। ক্যালেন্ডারের দিকে তাকালেও বোঝা যাচ্ছে পুজো আসতে আর বেশি সময় নেই। তাই জোরকদমে চলছে প্রস্তুতি। থিম বাছাইয়ের কাজ শেষ। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে চলছে ভাবনাকে রূপ দেওয়ার কাজ। বছরে একবার উমা বাপেরবাড়ি আসে, তার প্রস্তুতি বলে কথা। তাই তো বনেদি বাড়ির সদস্যদেরও বসে থাকার ফুরসত নেই। আগমনির আগমনের প্রস্তুতিতে বেজায় ব্যস্ত তাঁরা। ব্যতিক্রম নেই দক্ষিণ ২৪ পরগনার সরিষার বসুবাড়িও। সেখানেও দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি তুঙ্গে।
বনেদি বাড়িগুলির ইট-কাঠ-পাথরে কান পাতলেই শোনা যায় ইতিহাসের হাতছানি। তার ব্যতিক্রম নেই সরিষার বসুবাড়িতেও। টাইম মেশিনে চড়ে বরং একটু অতীতের দিনগুলিতে ফিরে যাওয়া যাক। এই ধরুন ১১২২-১১৩৯ সাল। মহারাজ বল্লাল সেনের রাজত্বকাল চলছে। সেই সময় বাংলাদেশ নিবাসী এই বসু পরিবারকে কৌলিন্যের মর্যাদা দেন বল্লাল সেন। আদিপুরুষ ছিলেন দশরথ বসু। এই বংশেরই বিশতম পুরুষ ছিলেন শ্রীরাম বসু। তিনি ছিলেন মুর্শিদাবাদের নবাবের কর্মচারী। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমে সরকারি কাজে পিতৃভূমি পাঁছিয়া থেকে তৎকালীন অবিভক্ত ২৪ পরগনা জেলার সরিষায় আসেন। সেসময় সেখানকার জমিদার ছিলেন জয়চন্দ্র মিত্র। তিনি শ্রীরাম বসুর বলিষ্ঠ চেহারা, কর্মতৎপরতা ও রূপলাবণ্যে মোহিত হন। ঠিক করেন তাঁর একমাত্র কন্যা অপরূপ সুন্দরী রম্ভাবতীর সঙ্গে বিয়ে দেবেন শ্রীরাম বসুর। হলও তাই। বিয়ের যৌতুক হিসেবে সরিষা গ্রামে জমিদারের সম্পত্তি লাভ করলেন শ্রীরাম বসু। পাকাপাকিভাবে সেখানেই বসবাস শুরু করলেন তিনি।
দালান বাড়িতে জাঁকজমক করে দুর্গাপুজো করতেন জমিদার জয়চন্দ্র মিত্র। বসুবাড়িতে তখনও পুজোর কোনও প্রচলন হয়নি। প্রতি পুজোর সময় তাই শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে বাপেরবাড়ি আসতেন রম্ভাবতী। মুখে কিছু না বললেও তা পছন্দ করতেন না জমিদারের জামাই শ্রীরাম বসু ও তাঁর আত্মীয় পরিজনেরা। তাই একবার ঠিক হল ঘরের বউকে পুজোর দিনগুলোতে শ্বশুরবাড়ি রাখতে বসুবাড়িতেও শুরু হবে দুর্গাপুজো। চারদিন ধরে গ্রামের মানুষের সঙ্গে উমার আরাধনায় মাতবেন বসু বাড়ির সদস্যরাও।
সেই শুরু। তারপর থেকে প্রাচীন রীতিনীতি মেনে আজও পুজো হয়ে আসছে বসু বাড়িতে। কালের নিয়মে এই পুজো এখন হয়ে উঠেছে প্রকৃত অর্থে বারোয়ারি। বসু বাড়ির পুজো এবার ৩০২ বছরে পা দিল। আগে প্রতি পুজোয় ছাগ বলি দেওয়া হত। শোনা যায়, একবার ছাগল বলিতে বাধা পড়ে। কাতান বলিপ্রদত্ত ছাগলের গলায় না পড়ে গিয়ে পড়ে হাঁড়িকাঠের উপর। বলিতে বাধা পেয়ে সকলেই খুব চিন্তিত। কী করা যায় ভেবে পরিবারের সদস্যরা যখন উদ্বিগ্ন, তখন ওই বাড়ির গৃহবধূ শতদলবাসিনী বসু নিজের বুক সামান্য চিরে সেই রক্ত দিয়েই পুজো দেন দেবীকে। সিদ্ধান্ত হয় পরের বছর থেকে পুজোয় কোনও বলি আর দেওয়া হবে না উমাকে। সেই সিদ্ধান্ত আজও অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন বসুবাড়ির সদস্যরা।
যেখানে প্রতিদিন লক্ষ্মী নারায়ণের পুজো হয়, সেখানেই প্রথমায় দেবীর বোধনঘট বসে। কয়েকদিন সেখানেই পুঁথির মন্ত্র পড়ে প্রথমাতে হয় দেবীর বোধন। যে পুঁথি থেকে মন্ত্রপাঠ হয় তা কিন্তু কোনও বাজারি পুঁথি নয়, বসুবাড়ির কোনও এক পূর্বপুরুষের পাওয়া এক প্রাচীন পুঁথি। যে কেউ সেই পুঁথি ছুঁতে পারেন না। দেবীর প্রাণপ্রতিষ্ঠার পর পরিবারের সবচেয়ে প্রবীণ সদস্য স্নান সেরে সেই পুঁথি পুরোহিতের কাছে আনেন। ষষ্ঠীর দিন বেলতলায় বোধনের ঘটপুজো হয়। এরপর শুরু হয় সপ্তমী পুজোর আয়োজন।
পরিবারের বর্তমান সদস্য সুদীপ বসু জানান, বংশ পরম্পরায় মৃৎশিল্পী বসু বাড়ির দুর্গাপ্রতিমা গড়েন। পুজোর পুরোহিতও বংশ পরম্পরায় পুজো করেন। অগ্নিমূল্যের বাজারে এখন বেশ খানিকটা ম্লান বসু পরিবারের পুজোর জাঁকজমক। তবে পুজোর চারদিন বসুবাড়িতে যেন অন্য মেজাজ তৈরি হয়। একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, পুজোর উপাচার সাজানো, পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া, কলাবউ স্নানে অংশ নেওয়া, সন্ধ্যারতি দেখা, দশমীতে মহিলাদের সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠেন সকলেই। প্রতিমা বিসর্জনের পর দশমীর রাতেই ঠাকুর দালানের মাঠে চলে মিষ্টিমুখ। তারপর আবারও শুরু হয় উমা আগমনির প্রতীক্ষা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.