টিটুন মল্লিক, বাঁকুড়া: আর মাত্র দিন কুড়ির অপেক্ষা। আবহাওয়াও জানান দিতে শুরু করেছে পুজো দোরগোড়ায় হাজির। স্বাভাবিকভাবেই কেনাকাটা প্রায় শেষের পথে। কিন্তু পুজোর মুখে এবার মন্দার ছায়া পড়েছে বাঁকুড়ার ঐতিহ্যবাহী বালুচরি, স্বর্ণচরি সিল্ক শিল্পে। মন্দার আবহে আরও জীর্ণ হতে বসছে তাঁত শিল্প। নদিয়ার ফুলিয়া, হুগলির ধনেখালি মতো বিষ্ণুপুরের বালুচরি, স্বর্ণচরি এবং সোনামুখী সিল্ক শাড়ির কদর কিন্তু ক্রেতাদের কাছে খুব একটা কম নয়। আর এই বয়ন শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা তাঁত শিল্প বাঁকুড়ার অর্থনীতির অন্যতম চাবিকাঠি। কিন্তু এই পুজোর মরশুমে তাঁত শিল্পী মহল্লায় মাছি তাড়াচ্ছেন শিল্পী-সহ কর্মীরা। ফলে মাথায় হাত শিল্পীদের।
সোনামুখী সিল্কের কপালে অধিকার সুরক্ষায় এখনও জিআই ট্যাগ জোটেনি। কিন্তু বিষ্ণুপুরের বালুচরি শাড়ির ক্ষেত্রে সেই ট্যাগ অবশ্য জুটেছে বহু আগেই। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে জেলা প্রশাসনের তরফে তাঁত শিল্পীদের আর্থিক ঋণ, যন্ত্রপাতি দিয়ে সাহায্য করা হয় বলে জানান বাঁকুড়ার জেলাশাসক উমাশংকর এস। তবে এ প্রসঙ্গে অন্য কথা শোনালেন বাঁকুড়া জেলা ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প দপ্তরের কর্মাধ্যক্ষ অংশুমান চক্রবর্তী। তিনি বলেন, “কেন্দ্র সরকারের অর্থনীতির জেরেই কপাল পুড়ছে তাঁত শিল্পীদের।” আর জেলা পরিষদের সভাধিপতি বলেন, “নোট বাতিল, জিএসটিতেই এমন বেহাল অবস্থা তৈরি হয়েছে তাঁতিদের।”
মল্ল রাজাদের আমলে বাঁকুড়া জেলায় প্রথম এই শাড়ি শিল্পের সূচনা হয়। ক্রমেই এই বয়ন শিল্পে ঝোঁক বাড়তে থাকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই বয়ন শিল্পের বাড়বাড়ন্ত হয়। এখন বিষ্ণুপুরে হস্তচালিত তাঁতের পাশাপাশি যন্ত্রচালিত তাঁতও এক বিরাট অংশ দখল করে নিয়েছে। সাম্প্রতিক প্রশাসনিক এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে প্রায় ৮৫ শতাংশেরও বেশি মানুষ এখনও তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন। এক্ষেত্রে সাধারণত তিন ধরনের ব্যবস্থা লক্ষ করা গিয়েছে। প্রথমত, স্বাধীন তাঁতি, যাঁরা মহাজন বা তৃতীয় কোনও ব্যক্তির হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বাধীনভাবে কাজ করেন। কাঁচামাল আনা থেকে শুরু করে উৎপাদিত সামগ্রী বাজারে বিক্রি-সব নিজেরাই করেন। বিষ্ণুপুর ও সোনামুখীতে এই ধরনের তাঁতির সংখ্যা এক সময়ে প্রচুর হলেও এখন বেশ কম। সরকারি পরিচয়পত্র অনুসারে এমন শিল্পীর সংখ্য ১০ হাজার।
দ্বিতীয়, পরাধীন তাঁতি। যাঁরা খুব গরিব এবং এজন্য তাঁরা সম্পূর্ণভাবে মহাজনের উপর নির্ভরশীল। এমন তাঁত শিল্পীদের সংখ্যা সব থেকে বেশি। সরকারি পরিচয়পত্র অনুসারে এমন শিল্পীর সংখ্য ৩৫ হাজার। এঁরাই এই শিল্পের প্রাথমিক কারিগর। প্রাথমিক বিনিয়োগ থেকে শুরু করে কাঁচামাল আনা, উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রি-পুরোটাই মহাজন নির্ভর। আর এই পরিস্থিতির সুযোগে গরিব তাঁতিদের এখনও ইচ্ছেমতো শোষণ করে থাকেন মহাজনের দল। আর তৃতীয় গোত্রের তাঁতিরা সংখ্যায় বেশ কম হলেও তাঁদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভাল। সরকারি পরিচয়পত্র অনুসারে এমন শিল্পীর সংখ্য ১২ হাজার। এঁরা কোনও একটি নির্দিষ্ট সমবায়ের অধীনে কাজ করেন। এই তিন ধরনের তাঁতিরাই মূলত বিষ্ণুপুর বয়ন কেন্দ্রের মূল কারিগর। সরকারি পরিচয়পত্র পাওয়া এমন ৫৭ হাজার শিল্পীর মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশ শিল্পী তাঁত শিল্পে বা বুনন শিল্পে কাজ না করে অন্য কাজ করেন।
সমবায়ের সঙ্গে যুক্ত শিল্পীরা জানান, “এই শিল্পে ক্রমাগত থাবা বসাচ্ছে অর্থনৈতিক মন্দা। ফলে এই শিল্প ক্রমেই বিবর্ণ থেকে বিবর্ণতর হচ্ছে।” তাঁত শিল্পী শিবু দাস বলেন, “প্রায় চার বছর শাড়ি বুনছি। পায়ে কোমরে ব্যাথা না থাকলে আমিও অন্য কাজের সন্ধান করতাম।” কো-অপারেটিভ উইভার্স সোসাইটি জানাচ্ছে, গত বছর পুজোর আগে দৈনিক ৭০ হাজার থেকে এক লক্ষ টাকার শাড়ি বিক্রি হয়েছে। এবার সেই অঙ্ক নেমে এসেছে ৩০ থেকে ৪০ হাজারে। দোকানদাররা অনেকেই দাবি করেন, গত দু’-তিন মাসে এমনও দিন গিয়েছে যে একটি শাড়িও বিক্রি হয়নি। এমনকী, অনলাইনেও শাড়ি বিক্রিতে তেমন সাড়া মিলছে না বলে শিল্পীদের একটি বৃহত্তর অংশ দাবি করেছেন। জেলা প্রশাসনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্তা বলেন, কেন্দ্র সরকারের সুতো, তাঁত শিল্পের সঙ্গে যন্ত্রপাতি-সহ আনুষাঙ্গিক দ্রব্যাদির উপর জিএসটি চাপানোর জেরে শিল্পীদের নাভিশ্বাস ওঠার যোগাড় হয়েছে। ফলে এই শিল্প ক্রমাগত ধুঁকছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.