নিজস্ব সংবাদদাতা, বনগাঁ: একসময় প্রতিবছর অষ্টমীর দিন বস্ত্র বিতরণ হত বনগাঁর ছয়ঘরিয়া গ্রামের বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়িতে। ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে উপস্থিত থেকে দরিদ্র মানুষদের বস্ত্র দান করতেন। অতীতের সেই জৌলুস আজ অনেকটাই ফিকে৷ কিন্তু ম্লান হয়নি মায়ের উৎসবে। অতীতকে স্মরণ করে আজও একইভাবে মা দুর্গা পুজিত হন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় স্মৃতি বিজড়িত বাড়ির ঠাকুরদালানে।
৩০০ বছরের বেশি প্রাচীন বনগাঁর ছয়ঘরিয়া গ্রামের বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির দুর্গাপুজো৷ আজ সেই স্মৃতি আঁকড়ে দিন কাটাচ্ছে বন্দোপাধ্যায়ের পরিবার৷ এখানে মা দুর্গার ১০টি হাতের মধ্যে ২টি হাত বড়। বাকি ৮টি হাত বেড়ালের মতো ছোট ছোট। তাই এই দুর্গা প্রতিমার অন্য নাম ‘বেড়াল হাতি দুর্গা’। কথিত আছে, এই বংশের সদস্য গৌরহরি বন্দ্যোপাধ্যায় স্বপ্নে এমন মূর্তি দেখতে পান। তারপর থেকে স্বপ্নে দেখা সেই আদলেই মূর্তি তৈরি করে মা পূজিত হচ্ছেন বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়িতে।
পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, এই গৌরহরিবাবু সম্পর্কে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটদাদু। কাজের সূত্রে তিনি বাইরে বাইরে থাকলেও পুজোর সময় এই বাড়িতে আসতেন। পরিবারের বর্তমান বর্ষীয়ান সদস্য চন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, জন্মাষ্টমীর দিন আমকাঠের তৈরি নতুন কাঠামোতে সিঁদুর পরিয়ে ঠাকুর দালানে প্রতিমা তৈরির পরম্পরা পালন করা হয়। ৩০০ বছর ধরে এই রীতিই চলে আসছে। ষষ্ঠীর দিন বেলতলায় পুজো দিয়ে ঠাকুর দালানে ঘট বসিয়ে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এক সময় সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত বলির প্রথা চালু ছিল। পরবর্তীতে তা বন্ধ হয়ে চিনি-নাড়ু দিয়ে নৈবেদ্য দেওয়ার প্রথা চালু হয়।
একসময় পুজোর ক’টা দিন বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়িতে একাধিক হাঁড়ি চড়ত। আশপাশের গ্রামের বাড়িগুলিতে পুজোর সময় রান্না হতো না। এই বাড়িতেই খাওয়াদাওয়া করতেন গ্রামের মানুষ। বর্তমানে সেসব আর করা হয়ে ওঠে না। শুধু নিষ্ঠাভরে এখনও পুজোর আয়োজন হয়ে আসছে। পুজোর দিনগুলিতে এখনও প্রচুর মানুষ আসেন এই বাড়িতে। কর্মসূত্রে নানাদিকে ছড়িয়ে থাকা এই বংশের সদস্যরা পুজোর সময় একত্রিত হন।
এই পুজোর প্রতিমা নিরঞ্জনের ব্যবস্থাতেও রয়েছে অভিনবত্ব৷ দশমীর দিন সন্ধ্যাতারা ওঠার পরই প্রতিমা নিরঞ্জনের ব্যবস্থা করা হয়। স্থানীয় নাওভাঙা নদীতে নিয়ে যাওয়া হয় প্রতিমা। দু’টি নৌকার উপর রেখে সাত পাক ঘুরিয়ে নৌকা দু’টিকে আস্তে আস্তে দু’দিকে সরিয়ে বিসর্জন করা হয়। বৃদ্ধা গৃহবধূ শোভা বন্দোপাধ্যায় বলেন, “শতাব্দী প্রাচীন থালা-বাসনেই আমাদের পূর্বপুরুষের স্মৃতি। সেই থালা-বাসনগুলি আজও পূজার্চনাতে ব্যবহৃত হয়। আগে পুজো এলে পরিবারের সবাই বাড়িতে চলে আসতো। রাতে ঘরে ঘুমানোর জায়গা হত না। কিন্তু আগের মতো জৌলুস নেই। পুজো এলেই সেইসব পুরনো স্মৃতি তাড়া করে বেড়ায়৷” স্মৃতিটুকু সম্বল করেই এখন পুজো কাটে তাঁর মতো বাড়ির অনেক সদস্যের। আজও গলায় আঁচল জরিয়ে বরণ করেন ঘরের মেয়ে উমাকে। জৌলুস না হয় নাই থাকল, মেয়ে যে ঘরে আসছে এই বা কম কী?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.