সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: ওদিকে একলাইনে লম্বা অযোধ্যা পাহাড়ের রেঞ্জ। আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা টিলা। তার পাশেই উঁকি দিচ্ছে কাশের বন। যেন উপচে পড়ছে কুমারীর নীল জলরাশি। সেই মেঠো পথেই সবুজ সাথীর সাইকেলে চড়ে মা উমা আসছেন ঘরে! এও এক ‘উমা’! আরেক ‘দুর্গা’! কারণ, নাচের তালে তালেই বহু মানুষকে ফিরিয়ে এনেছেন মূল স্রোতে। যেই ‘উমা’ হারতে হারতে লড়াই করেও জিতে যায়। আঁধার মুছে আলোর পথে পাড়ি দেয় মৌসুমি চৌধুরি।
পুরুলিয়ার বনমহল বলরামপুরের মালডি গ্রামের বাসিন্দা মৌসুমি। বয়স বাইশ। সিধো-কানহো-বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা স্নাতকোত্তরে পাঠরতা। সমাজের বাঁকা চোখকে পরোয়া না করে বন্ধ ঘরে ধামসার তালে ‘দুর্গা’ নাচতেন। আর আজ নিজেই একটি মহিলা ছৌ দল গড়ে নিয়েছেন এই তরুণী। বীর রসের পৌরুষদীপ্ত নাচ রপ্ত করে শুধু মেয়েদের নয় পুরুষদেরও ছৌ নাচের পাঠ দিচ্ছেন। ছৌয়ের তাল শিখিয়ে মানসিক রোগীদেরও ঘরে ফেরাচ্ছেন। পাড়ি দিয়েছেন নরওয়ে। বিদেশেও একই ভাবে তালিম দিচ্ছেন পুরুষ-মহিলাদের। শেখাচ্ছেন বীর রসের নাচের তাল। কী ভাবে পা ফেললে কানে বাজে ছৌয়ের পদধ্বনি! পুরুষের নাচ মজ্জায় নিয়ে ইউনেস্কোর সদর দপ্তর ফ্রান্সের প্যারিসেও ইতিমধ্যে জায়গা করে নিয়েছে বাংলার ‘উমা’ মৌসুমির লড়াইয়ের গাথা।
তখন ক্লাস নাইন। ঘরে দাদুর গলায় জাঁতমঙ্গলের সুর। বাবা-কাকাদের ছৌ নেচে ভোর রাতে ফেরা। সকালে চোখ মুছেই ধুলো ও ঘামে ভেজা রংবাহারি পোশাক জলে ধোওয়া। বাবা-কাকাদের নাচের অনুশীলনের সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকা। এভাবেই কিশোরী মৌসুমি কখন যে অবলীলায় ছৌ নাচের প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করেছে, তা টেরও পায়নি। পৌরুষদীপ্ত এই নাচ নিয়ে তখন মৌসুমিকে কত কটাক্ষ লোকজনের। তার এই পাগলামিতে প্রায় হাসির রোল পড়ে গিয়েছে মালডিতে। কত অপমান। কত কথা। কত গঞ্জনা।
‘বিটি হয়ে আবার ছৌ নাচবে কী রে?’ চোখের জল দু’হাতে মুছে দরজায় খিল দিয়ে আয়নার সামনে শুরু দুর্গা নাচা। তখন বন্ধ ঘরের বাইরের মাঠে যে ধামসা-মাদলের তালে চলছে মহিষাসুরমর্দিনীর মহড়া। মৌসুমির কথায়, “ওই ধামসা বাজলেই শরীরে একটা আন্দোলন খেলে যেত। অনুরনন হত। শিহরন জাগত। কেঁপে উঠত শরীর-মন সব। তখন বন্ধ ঘরে ওই বাজনার আওয়াজেই দাঁতে-দাঁত চিপে দুর্গার নাচের তাল হজম করতাম।”
মেয়ের এমন নাচ আচমকাই চোখে পড়ে যায় বাবা জগন্নাথ চৌধুরির। ব্যস, তারপর তো ইতিহাস! একের পর এক প্রতিবন্ধকতাকে হারিয়ে ক্লাস ইলেভেনেই বীর রসের এই নৃত্যকলা রপ্ত করে মহিলা দল তৈরি করে নেন মৌসুমি। আর এখন কালমৃগয়া, লক্ষ্মনের শক্তিশেল, অভিমন্যু বধ, এমনকী ম্যাকবেথ পালাতেও নাচছে তার দল। মিতালি ছৌ মালডির (মহিলা) ১২ জন সদস্য নজর কাড়ছে সকলের। তাই সকালে উঠেই ফুরসত নেই মৌসুমির। গ্রামের ছৌ রিসোর্স সেন্টারে কসরত। ১০টা বাজার আগেই লম্বা চুল খোপা করে মুখে কিছু দিয়ে সবুজ সাথীর সাইকেলে চড়ে ৩ কিমি পথ ভেঙে উরমা। সেখান থেকে বাসে চড়ে আবার শহর পুরুলিয়া। তারপর টোটো বা অটো ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। দিনভর পাঠ নিয়ে আবার একই পথে বাড়ি। ওই পোশাকেই ওড়না কোমরে বেঁধে শুরু হয়ে যায় নাচের পাঠ দেওয়া। শনি-রবিবার ছুটির দিনেও কলকাতায় কর্মশালা।
ছৌ নেচে রাজ্য পুলিশের ‘স্বয়ংসিদ্ধা’ প্রকল্পে বাল্যবিবাহ, নারী পাচার রোখার বার্তা দেওয়া। কখনও আবার পুরুলিয়াতেই ছৌয়ের ক্লাসের পর ক্লাস। ওদিকে তার মোবাইলের রিং টোনে বাজছে, ‘যা দেবী সর্বভূতেষু/শক্তিরূপেন সংস্হিতা….’। যা আবারও আগমনীর বার্তা দেয়। বিরাম নেই এই ‘উমা’র। রণক্লান্ত না হয়ে দুর্গার মুখোশে ছৌ নেচে চলেছেন মৌসুমি। বাবার পেশাকে যে মেয়েরাও আপন করে নিয়ে দিগ্বিজয়ী হয়ে উঠতে পারে, পুরুলিয়ার মৌসুমি সেই বার্তাই আবার তুলে ধরল সমাজের সামনে।
ছবি- অমিত সিং দেও
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.