নবেন্দু ঘোষ, বসিরহাট: অনেকদিনের স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে এবার। সসম্মানে নিজের পাড়ায় দুর্গাপুজো দেখবেন কাকলি-স্বপ্নারা (নাম পরিবর্তন)। আনন্দ করবে, নাচ-গান করবেন। যৌনকর্মী বলে কেউ তাঁদের দিকে আর বাঁকা চোখে দেখবে না। তাঁরাই যে এবার দুর্গা আরাধনার আয়োজন করেছেন। আগামী সাতটা দিন এঁরা ব্যস্ত থাকবেন দুর্গাপুজোয়।
বসিরহাটের মাটিয়ার যৌনপল্লিতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে কানে ভেসে আসে গান – ‘মনটা যদি না থাকত তো কিছুই মনে পড়ত না।’ এই গান নিজেদের অজান্তেই কীভাবে তাঁদের জীবনের সঙ্গে মিলে গেছে বলে বলছেন পাড়ার তানিয়া পারভিন, তাপসী মণ্ডলরা। তাঁদের কথায়, ‘এবার প্রথম হয়ত স্বাধীনতার স্বাদ পাব। তাই তো আমরা, যৌনপল্লির মেয়েরা দুর্গা আরধনায় ব্রতী হয়েছি।’ কাপড়ের আঁচল দিয়ে চোখের কোণ মুছে তানিয়া বলছেন, ‘এই কারাবন্দি দশা কার ভাল লাগে বলুন? তবুও থাকতে হয়, যাওয়ার মতো জায়গা নেই তাই…’। একটু উদাস সুরে বছর বাইশের তাপসী বলে তাঁর করুণ জীবনকথা। ভালবেসে বিয়ে করেছিল। কিন্তু মদ্যপ স্বামী তার বাচ্চাকে মেরে অন্য একজনের সঙ্গে গ্রাম ছাড়ে। অসহায় মহিলা দ্বিতীয়বার ভালবেসে বিয়ে করে মুম্বইতে বেড়াতে যায়। আর তখনই তার ভুল ভাঙে। সেখানে স্বামী তাকে বিক্রি করে দিয়ে পালায়।
এরপর কেটে গিয়েছে অনেকটা সময়। জমে গিয়েছে অনেক কথা। বিভিন্ন ঘাটে ঘুরতে ঘুরতে শেষে মাটিয়ার নিষিদ্ধ পল্লিতে তার ‘ঘর’ হয়। তাই তো তাপসীর মত অনেকের ইচ্ছা থাকলেও আত্মীয়-পরিজনদের সঙ্গে মিলে দুর্গাপুজোর দিনগুলিতে আনন্দে মেতে ওঠা হয়নি। বাইরে যখন হই-হুল্লোড়, তখন ঘরের এক কোণে বসে দিন অতিবাহিত করা ছাড়া পথ পান না নিষিদ্ধপল্লির মেয়েরা। তাঁরাই এবারে দুর্গাপুজোর আয়োজক।
বসিরহাট দুর্বার সমিতির পরিচালনায় মাটিয়ার নিষিদ্ধ পল্লিতে হতে চলেছে দুর্গাপুজো। সহযোগিতায় যৌনকর্মী এবং বাড়িওয়ালাবৃন্দ। তাই খুশিতে মাতোয়ারা সেখানকার ৯২৮ জন যৌনকর্মী। পুজোর পাশাপাশি নাচ,গান পরিবেশনের জন্য জোরকদমে মহড়া চলছে। আয়োজকদের অন্যতম স্বপ্না গায়েনের কথায়, এখানকার যে মহিলারা পুজোর সঙ্গে যুক্ত থাকবেন, তাঁদের যেমন শুদ্ধ হয়ে পুজোর আচার অনুষ্ঠান করতে হবে, তেমনই পুজোর দিনগুলিতে তাঁরা কোনও কাজ করতে পারবেন না। ওই সব মহিলারা একরকমের পোশাকও পরবেন। এবারে পুজোর বাজেট দেড় লক্ষ টাকা। পুজো কমিটির সদস্য রণজিৎ বিশ্বাসের কথায়, ‘অনেক সময়ে এঁদের সন্তানদেরও পুজোয় অংশ নিতে দেওয়া হয় না। তাই যৌনকর্মীদের নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়ার জন্য লড়াই করতেই দুর্গাপুজোর উদ্যোগ।’
পান্না, পামেলা, সখী, মোনালিসা, কল্পনা, রত্না, ভ্রমর, তাঞ্জিলারা এখন ব্যস্ত চাঁদা তুলতে। তাঁদের কথায়, ‘এতদিন কেবল আমাদের তাচ্ছিল্য করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে মণ্ডপে গিয়েও কটু মন্তব্য, হাসাহাসি, কানাকানি, এমনকি বাঁকা চোখের ইশারায় মায়ের অঞ্জলি পর্যন্ত দেওয়া হয়নি।তাই তো এবারে নিজেদের পুজোয় চুটিয়ে আনন্দ করতে চাই।ফল কাটব।লাল পেড়ে গরদের শাড়ি পরে জল সইব।সিঁদুরে রাঙিয়ে দেব মায়ের কপাল।’ তাঁদের মন্তব্য, যেখানে মায়ের মূর্তি গড়তে আমাদের ঘরের মাটির প্রয়োজন সেখানে যৌনকর্মীদের মা দর্শনে কেন এত বাধা, তা বুঝতে পারি না। আমরা মূল স্রোতে মিশতে চাই। ওই পাড়ার রেশমার কথায়, ‘বিষয়টি কী জানেন? আমি যখন কল শো’তে গিয়ে মহিষাসুর পালায় দুর্গা সাজি তখন কত মানুষই না হাততালি দিয়ে আমাদের অভিনন্দিত করেন।অথচ তারাই যখন শোনে যে আমরা যৌনকর্মী, তখন মুখ ফিরিয়ে নেয়। কেউ ভাবে না আমরাও মানুষ, পরিস্থিতির শিকার হয়ে এখানে বন্দি।’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.