রিংকি দাস ভট্টাচার্য: চেনা ছাঁচে ফেলা লক্ষ্মীর মুখ নয়। তবে অচেনাও নয়। এ মুখ গৃহলক্ষ্মীর। উত্তমকুমারের বাড়ির ঐহিত্যশালী লক্ষ্মীপুজোয় প্রতিমার মুখ গৃহকর্ত্রীর আদলে। গৃহকর্ত্রী বলতে উত্তমকুমারের স্ত্রী গৌরীদেবী। মহানায়কের ভবানীপুরের বাড়িতে এই গৌরীরূপী লক্ষ্মীর পিছনে অবশ্য একটা গল্প আছে।
শোনা যায়, ‘যদুভট্ট’ ছবির শুটিংয়ে মূর্তি গড়ছিলেন নিরঞ্জন পাল। শুটিং ফ্লোরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে সেই দৃশ্য চোখে পড়ে উত্তমকুমারের। তিনি শিল্পীকে বাড়িতে ডাকেন লক্ষ্মীপ্রতিমা গড়ার বায়না দেবেন বলে। শিল্পী বাড়িতে পৌঁছে উত্তমকুমারের খোঁজ করতে গিয়ে দেখেন, গৌরীদেবী ঘর মুছছেন। তিনি ঘোমটার ফাঁক থেকে এক ঝলক তাকিয়ে শিল্পীকে বসতে বলার পর উত্তমকুমারকে ডেকে দেন। কিন্তু ওই মুহূর্তেই শিল্পীর চোখে মা লক্ষ্মীর ছবি আঁকা হয়ে যায়। তিনি ছাঁচ ভেঙে গৌরীদেবীর মুখের আদলে লক্ষ্মীমূর্তি গড়েন। আজও প্রতিমার মুখের গড়নে সেই চেনা ছাপ।
মহানায়ক চলে যাওয়ার পরও পুজোর ধারা একইভাবে বজায় রেখেছে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের নতুন প্রজন্ম। নাতি-নাতনি গৌরব, নবমিতা ও মৌমিতার হাতেই এখন পুজোর দায়িত্ব। হয়তো ঠাঁটবাট কমেছে, কিন্তু ভক্তি বা নিষ্ঠায় ঘাটতি নেই। সেসময় সারাদিন নির্জলা উপোস করে বাড়ির কর্তা উত্তমকুমার নিজে পুজোয় বসতেন। “এটাই চট্টোপাধ্যায় বাড়ির পরম্পরা। দাদুর পর বাবা। এখন আমি। সারাদিন উপোস থেকে পুজোয় বসি।” জানাচ্ছিলেন মহানায়কের নাতি গৌরব চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, আলপনা থেকে বিসর্জন-পুজোর সব কাজের দায়িত্ব ভাইবোনেরা মিলে সামলায়।
১৯৫০ সালে ছেলে গৌতমের জন্মের বছরেই মহানায়ক উত্তমকুমারের ইচ্ছেয় ভবানীপুরে গিরিশ মুখার্জি রোডের চট্টোপাধ্যায় পরিবারে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো শুরু হয়। স্টুডিও পাড়ার মুখে মুখে ফেরে অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের বাড়ির কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো দেখেই নাকি উত্তমকুমারের সাধ হয় নিজের বাড়িতেও লক্ষ্মীদেবীর আরাধনা করার। ওই সময় স্টুডিও পাড়া থেকে আর্ট ডিরেক্টর এসে আলপনা দিতেন। গোটা বাড়ি জুড়ে তখন এলাহি ব্যাপার! সেই ধারা একইভাবে বজায় রেখেছে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের নতুন প্রজন্ম।
ঐতিহ্য মেনেই আজও পুজোর দিন ভোরে গঙ্গায় ডুব দিয়ে ঘট ভরে আনা হয়। উত্তমকুমারের আমল থেকে একটা বড় রুপোর ঘট বসানো হয় প্রতিমার সামনে। সেই সময় উত্তমকুমারের স্ত্রী গৌরীদেবী নিজের গয়নায় সাজাতেন মাকে। এখন কুমোরের বাড়ি থেকে মাটির অলঙ্কারেই সেজে আসেন মা। তবে মূর্তির ক্ষেত্রে কোনও আপস করা হয়নি। শিল্পী নিরঞ্জন পালের পর এখন তাঁর ভাইপো জয়ন্ত পালের হাতেই রয়েছে মহানায়কের বাড়ির প্রতিমা তৈরির দায়িত্ব। কুমোরটুলি থেকে আনা দেবীমূর্তির পরনে থাকে লালপাড় সাদা শাড়ি। বিসর্জনের সময় আবার দেবীকে লালপাড় শাড়ি পরানো হয়।
এ বাড়িতে পুজোর ভোগ তৈরির অধিকার শুধুমাত্র দীক্ষিত পরিবারের মেয়ে বা পুত্রবধূদেরই। ভোগে থাকে পোলাও, লুচি, ছোলার ডাল, পাঁচরকম ভাজা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, পায়েস। সেই সময় ভিয়েন বসিয়ে পান্তুয়া, গজা তৈরি হত বাড়িতেই। বালতি করে পান্তুয়া বিতরণ করা হত পাড়াপড়শিদের বাড়িতে। ভোজের আসরে বড় আকর্ষণ ছিল স্বয়ং উত্তমকুমারের উপস্থিতি। পুজোর পরে টালিগঞ্জের তাবড় প্রযোজক, গায়ক, অভিনেতারা পাত পেড়ে বসে ভোগ খেতেন। তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সকল নিমন্ত্রিতকে খাওয়াতেন। তার পরেই নিজে খেতে বসতেন। মেনুতে থাকত লুচি, ছোলার ডাল, বেগুন বাসন্তী, আলুর দম, ধোঁকার ডালনা, ছানার ডালনা, মিষ্টি। ইদানীং মেনুতে ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধন ঘটেছে। মিষ্টিও নিয়ে আসা হয় বাইরে থেকে।
দিনের বেলায় সাধারণ মানুষের জন্য অবারিত দ্বার ছিল ৪৬/ই গিরিশ মুখার্জি রোডের এই বাড়ি। রথ দেখা, কলা বেচার মতোই বছরের এই দিনটিতেই একযাত্রায় লক্ষ্মী এবং মহানায়কের দর্শন মিলত ভক্তজনের। শোনা যায়, মা লক্ষ্মীর কাছে চাওয়া বিশেষ মানত পূরণ হওয়ায় কাঙালি ভোজন করাতেন মহানায়ক। উত্তমকুমার, গৌরীদেবী নিজের হাতে পরিবেশন করতেন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.