মণিশংকর চৌধুরি ও সুচেতা সেনগুপ্ত: এবছর দুর্গাপুজোটা অন্যরকমভাবে কাটানোর কথা ছিল। কথা ছিল, খোলা আকাশের নিচে আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধবের হাত ধরে ঠাকুর দেখতে যাওয়ার। গত কয়েক বছরের চাপা পড়ে থাকা আনন্দ এবার সবটা ফুটে উঠবে। কিন্তু এতদিন ধরে বোনা স্বপ্নের কাছাকাছি পৌঁছনো দূরের কথা, বরং আরও অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে ওঁদের জীবনে। জাতীয় নাগরিকপঞ্জি তালিকা প্রকাশের পর। ওঁদের সমস্ত আশা খানখান করে দিয়েছে এই এনআরসি। ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে রেহাই মেলেনি অসমের কয়েক লক্ষ হিন্দু বাঙালির।
কিন্তু উৎসবের আলো কি ওদের জীবনে কখনও পড়বে না? নিরলস সেই চেষ্টাই করছে সারা অসম বাঙালি যুব-ছাত্র ফেডারেশন। অসমের মোট ৬টি ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি মানুষজনের হাতে নতুন জামাকাপড় তুলে দিলেন সংগঠনের সদস্যরা। তা পেয়ে প্রায় হাজারজনের মুখে হাসি ফিরেছে।
কোকরাঝাড়, তেজপুর, গোয়ালপাড়া, শিলচর – এই চার জায়গার ক্যাম্পে ছোট,বড় মিলিয়ে অনেকেরই জীবন কাটছে ডিটেনশন ক্যাম্পের লোহার খাঁচায়। অসমে এনআরসি প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর তাঁদের মনে আশা উঁকি মারছিল, এবার বুঝি সুদিন ফিরছে। জাতীয় নাগরিকপঞ্জি তৈরি যে হিন্দু বাঙালিদের সুরক্ষিত রাখার জন্য, বারবার সেই দাবিই করেছিলেন রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিরা। কিন্তু চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর দেখা গেল, ১২ লক্ষ হিন্দু বাঙালির নামই নেই। তাঁরা রাতারাতিই ‘বিদেশি’ হয়ে গিয়েছেন। ভবিষ্যত চূড়ান্ত অনিশ্চয়তার মুখে। একেবারে পুজোর মুখেই এমন বিনা মেঘে বজ্রপাতের ঘটনার ধাক্কা এখনও সামলাতে পারেননি অনেকেই। তাই ডিটেনশন
ক্যাম্পগুলিতেও পুজো বলতে কিছু নেই। তবে সারা অসম বাঙালি যুব-ছাত্র ফেডারেশনের উপহার পেয়ে অনেকেই কিছুটা উৎসবের আমেজ অনুভব করছেন।
যদিও হঠাৎ সবকিছু হারিয়ে ফেলা মানুষগুলোকে শুধুমাত্র পুজোর আনন্দ দিতেই সংগঠনের এই উদ্যোগ। বরং এই পরিস্থিতিতে দরদী মন নিয়ে তাঁদের পাশে দাঁড়াতে চায় সারা অসম বাঙালি যুব-ছাত্র ফেডারেশন। কারণ, তাঁরা দিব্যি বুঝতে পারছেন যে এই এনআরসি, ডিটেনশন ক্যাম্প – এসবই আসলে রাজনীতির একটা চাল। যা সাধারণ মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে নিজেদের প্রয়োজনেই অধিক ব্যবহার করছে ক্ষমতাশালী দল। তাই বিজেপির বিরুদ্ধেই গর্জে উঠেছেন তাঁরা। সংগঠনের সভাপতি দীপক দে’র কথায়, ‘ডিটেনশন ক্যাম্পগুলিতে যে সব হিন্দু বাঙালিরা রয়েছেন, ২১ অক্টোবরের মধ্যে তাঁদের নিঃশর্তে মুক্তি না দিলে, ওইদিন সারা অসমজুড়ে বৃহত্তর আন্দোলন হবে। তখন সরকার বুঝবে, অসমে হিন্দু বাঙালিদের ক্ষমতা কতটা। হয় লড়ব, নয় মরব।’
সংগঠনের কেন্দ্রীয় সমিতির কার্যকরী সভাপতি তপজ্যোতি সেনের কথায়, ‘আমরা পুজোর আগে ডিটেনশন ক্যাম্পগুলোতে ঘুরে ঘুরে সকলকে জামাকাপড়, কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়েছি। আসলে, এদের জন্য তো ভাবার কেউ নেই। রাজনৈতিক নেতারা সব বলে চলে যান। কাজের কাজ হয় না। এসব ক্যাম্পের পরিস্থিতি চোখে না দেখলে বোঝাই যাবে না যে দুর্বিসহ অবস্থার মধ্যে এঁদের দিন কাটাতে হয়। আমরা তো দাবি করেছি যে কাউকে আটকে রাখতে হলে ডিটেনশন ক্যাম্পে নয়, জেলে আটকে রাখা হোক। সেখানে অন্তত মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে না। এসব ক্যাম্পে বহু অপরাধমূলক কাজও হয়। আমরা অসমের মুখ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে সব কথা
জানিয়েছি। প্রয়োজনে আবারও দিল্লি গিয়ে দরবার করব।’ তিনি আরও বলেন যে মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনওয়াল কথা দিয়েছিলেন, পুজোর আগে এসব ক্যাম্প থেকে হিন্দু বাঙালিদের মুক্তি দেওয়া হবে। কিন্তু কথা রাখেননি তিনি। আর তাতেই বিজেপির উপর ক্ষোভ বাড়ছে সংগঠনের সদস্যদের।এবছর তাই দুর্গতিনাশিনীর কাছে এঁদের সকলের প্রার্থনা, এতদিনের দুর্গতি এবার সত্যিই নাশ হোক।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.