ছবিতে সারেঙ্গার পালবাড়ির মা দুর্গা, ছবি : সাধন মণ্ডল।
পুজো প্রায় এসেই গেল৷ পাড়ায় পাড়ায় পুজোর বাদ্যি বেজে গিয়েছে৷ সনাতন জৌলুস না হারিয়েও স্বমহিমায় রয়ে গিয়েছে বাড়ির পুজোর ঐতিহ্য৷ এমনই কিছু বাছাই করা প্রাচীন বাড়ির পুজোর সুলুকসন্ধান নিয়ে হাজির sangbadpratidin.in৷ আজ রইল সারেঙ্গার পালবাড়ির দুর্গাপুজোর কথা।
দেবব্রত দাস, সারেঙ্গা: বাঁকুড়ার জঙ্গলমহল হিসাবে পরিচিত সারেঙ্গা। আর এই সারেঙ্গার পালবাড়ির পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক মহীয়সী মহিলার নাম। গ্রামের মানুষের কাছে যিনি ‘গিন্নিমা’ নামে পরিচিতি। সারেঙ্গা ব্লকের ধবনী গ্রামের পালবাড়ির দুর্গাপুজো তাই লোকমুখে ‘গিন্নিমা’র পুজো নামেই প্রচলিত।
জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত গ্রাম ধবনী সারেঙ্গা থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একফালি গ্রাম। কথিত আছে সারেঙ্গা লাগোয়া ধবনী, দাঁড়কেনি, দুলেপাড়া, দুবনালা, করাপাড়া, লাউপাড়া, আমদানি, আমঝোড়, কুমারপুর, আমডাঙা-সহ ৮৫টি মৌজার জমিদার ছিলেন পালরা। তাঁদের পূর্বসূরি ‘গিন্নিমা’ শ্যামাসুন্দরী পাল ১৭৫ বছর আগে ধবনী গ্রামে এই দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন। সেই পুজোই লোকমুখে প্রথমদিকে জমিদার বাড়ির পুজো নামে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু পরবর্তীতেক ‘গিন্নিমা’-র পুজো নামে খ্যাতি পায়। জমিদারি চলে গেলেও পুজো অবশ্য বন্ধ হয়নি। ধবনী গ্রামের মধ্যে একমাত্র দুর্গাপুজো হয় পালবাড়িতেই। এই পারিবারিক পুজো বর্তমানে গ্রামের সর্বজনীন পুজোয় পরিণত হয়েছে। পাল পরিবারের তিন পুকুরের মাছ চাষের আয় ও বর্তমান বংশধরদের অর্থানুকূল্যেই পুজো চলে। এক সময় দারিদ্র থাবা বসিয়েছিল জমিদার পরিবারে। কিন্তু কোনও প্রতিকূলতাই ধবনী গ্রামের একদা জমিদার পাল বাড়ির ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপুজোকে বন্ধ করতে পারেনি। এখনও মহা সমারোহে চলে পুজো। এবার এই জমিদার বাড়ির পারিবারিক পুজো ১৭৬ বছরে পড়ল।
জমিদার বাড়ির বর্তমান বংশধর সোমপ্রকাশ পাল, শোভন পাল বলেন, “১৭৫ বছর আগে ‘গিন্নিমা’ শ্যামাসুন্দরীদেবী স্বপ্নাদেশ পেয়েই বাড়িতে দুর্গাপুজোর প্রচলন করেছিলেন বলে শুনেছি। তবে এ ব্যাপারে প্রামাণ্য নথি বলতে আমাদের কাছে কিছু নেই।” পালবাড়ির অতীতের পুজোর কথা এখনও লোকমুখে ফেরে। পুজোর চারদিন মন্দিরের সামনে মেলা বসত, যাত্রা হত। প্রতিবেশী গ্রামের মানুষ পাত পেড়ে খেতেন। পুজোর ক’টা দিন গ্রামে হইহই ব্যাপার হত। ঠাকুর দেখতে এ-বাড়িতে ভিড় উপচে পড়ত। ব্রিটিশ আমলেই পালদের জমিদারি চলে গিয়েছিল। এখন তিনটি পুকুর লিজে দেওয়া হয়েছে। তা থেকে যা টাকা পাওয়া যায় তাই দিয়ে পুজোর খরচ কিছুটা হয়। বাকিটা পরিবারের সবার অর্থ সাহায্যে সম্পন্ন হয়। গ্রামের কারও কাছ থেকে কোনও চাঁদা নেওয়ার চল নেই। যতটা সম্ভব সাড়ম্বরে পুজো করা হয়। পূর্ব পুরুষের আমলের মন্দির সংস্কার করে সম্প্রতি মার্বেলও বসানো হয়েছে।
আশপাশের গ্রাম মিলে একমাত্র পুজো এই পালবাড়িতেই। পুজো দেখতে তাই ফি-বছর বহু মানুষ এখনও ভিড় করেন। পারিবারিক এই পুজো তাই সর্বজনীনের চেহারা নিয়েছে। অভাব থাকলেও পালবাড়ির পুজোয় চিরাচরিত রীতি আজও অমলিন। পালবাড়িতে গোস্বামী মতে পুজো হয়। একারণেই বলি হয় না। দশমীর রাতে গ্রাম পরিক্রমার পর স্থানীয় এটেলবাঁধ পুকুরে প্রতিমা নিরঞ্জন হয়। বিসর্জন শেষে পরিবারের সদস্যরা একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করা বহুকালের রীতি। জমিদারি চলে গেলেও পাল বাড়ির দুর্গাপুজোর আন্তরিকতায় তিলমাত্র ভাটা পড়েনি। জীবন জীবিকার টানে বছরভর বাইরে থাকলেও পুজোর টানেই গ্রামে ফেরেন এই পরিবারের সদস্যরা।
শোভনবাবুর কথায়, “একটা পুজোকে কেন্দ্র করে গ্রামের মানুষের সঙ্গে গোটা পরিবার এক সামিয়ানার নিচে এসে জোটে। এটা কী কম পাওয়া।” দারিদ্রকে দূরে ঠেলে ‘গিন্নিমা’র দুর্গাপুজোর ঐতিহ্যকে আজও টিকিয়ে রেখেছে ধবনীর পাল পরিবার।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.