ছবিতে রূপান্তরকামী সায়ন্তনী ঘোষ।
শাম্মী আরা হুদা: আর মাত্র কয়েকটা দিন, তারপরেই জগজ্জননী দুর্গতিনাশিনী মা দুর্গা সপরিবারে মর্ত্যে এসে পড়বে। পাড়ায় পাড়ায় বনেদি বাড়ির ঠাকুর দালানে মায়ের আরাধনায় মেতে উঠবে উৎসবপ্রিয় বাঙালি। অষ্টমীর অঞ্জলিতে যখন নতুন শাড়ির খসখস শব্দে মিশে থাকবে পাড়ার তরুণীকুলের ভিড়, তখন কেউ হয়তো খিড়কির দরজা ধরে লুকিয়ে কাঁদবেন। দক্ষিণের বারান্দায় অষ্টমীর সকালের ঝকঝকে রোদ তাঁকে ব্যঙ্গ করবে। কেননা তিনি পুজোর আনন্দে ব্রাত্য, দেবীপক্ষে বঞ্চনার শিকার। পাড়ার পুজোর উলুধ্বনি শোনা যেতেই কানে আঙুল দেয় সায়ন্তনী, থুড়ি সায়ন্তন। তখনও যে পুরোপুরি সায়ন্তনীতে রূপান্তর ঘটেনি। রাস্তায় বেরলেই হাজারটা চোখ যেন গিলে খেতে আসে। কোথাও ঘৃণামিশ্রিত চাহনি, কোথাও বা মজা দেখার প্রয়াস। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত সায়ন্তনকে গিলে খাচ্ছে চোখগুলো, সঙ্গে টিটকিরি।
বাড়িতে বাবার রাগী চোখ, বাইরে হাজারো দৃষ্টি। এর মাঝে ষষ্ঠী যে কখন বিজয়াতে গিয়ে ঠেকেছে খেয়ালই নেই। সায়ন্তনের পুজো কেটেছে চার দেওয়ালের মধ্যে। এয়োস্ত্রীদের সিঁদুরে রাঙা মুখ দেখে, মায়ের চলে যাওয়া টের পেত বছর ২০-র তরুণ। ভিতরে দলা পাকিয়ে ওঠা কান্নাকে গলার গাছেই আটকে দিত, তখনও তো সায়ন্তনী হয়নি সে। তাই কাশফুল দেখে চিরন্তন আনন্দে ভেসে যেতেও বড় ভয় তার। না জানি কী অপমান রয়েছে আনন্দের ওপারে।
এসব দেখেই হয়তো অলক্ষ্যে মুচকি হেসেছিল উমা। মা কি তার সন্তানকে কাঁদতে দেখতে পারে, যে সন্তান ততক্ষণে অপমানের আগুনে পুড়ে খাঁটি সোনার রূপ পেয়েছে। যে সে রূপ নয়, দেবী রূপ। এই রূপের মহিমা অস্বীকার করবে সাধ্যি কার? শঙ্খ-উলুধ্বনির মাঝে মাকে বরণ করার ইচ্ছে হয়েছিল। দশমীতে আর পাঁচজন বঙ্গ ললনার মতো মিষ্টিমুখ করিয়ে ঘরের মেয়ে বিদায় দেওয়ার। বাইরের আবরণ নয়, মনের সায়ন্তনী কেঁদে কেঁদে ফিরছিল। পথ খুঁজে দিল মা, জন্মদাত্রী। মনের মেয়েকে প্রকাশ্যে আনার সংকল্প সত্যি হল। মায়ের সনির্বন্ধ প্রেরণায় সায়ন্তন বদলে গেল সায়ন্তনীতে। এরমধ্যে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে। পাহাড়প্রমাণ অপমান কেমন শক্তিরূপে সায়ন্তনীকে আগলে রাখে আজকাল। এত ঝড়ঝাপটার মধ্যেই একদিন আইনপাশের শংসাপত্র হাতে পেয়ে গেলেন ওই তরুণী। সোনারপুরের সায়ন্তনী ঘোষ এখন বিশিষ্ট আইনজীবী। ইতিমধ্যেই বিবাহবিচ্ছেদের মামলা জিতে হাতেখড়িও হয়ে গিয়েছে তাঁর। এখন আর ‘মেয়েলি’ বলে পুজো মণ্ডপে হেনস্তা দূরের কথা, পাড়ার মোড়ে নামলে কেউ আর বাঁকা চোখে তাকায় না, বরং দৃষ্টিতে প্রশংসাই ঝরে পড়ে। মনে মনে নিজেকেই ধন্যবাদ দেয় সেদিনের মেয়ে।
একদা পাড়ার মোড়ের দাদা, থেকে পাশের পাড়ার বউদি, কে তাঁকে দেখে আড়ালে হাসেনি! ছেলেদের তিরস্কার, মেয়েদের চোখে তাচ্ছিল্য। অন্ধকার নামলে এসব মিশিয়েই ভাত মাখতেন সায়ন্তনী। মেয়ের কষ্ট মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতেন মা বীথিকাদেবী। সেসব এখন অতীত। এবছর সোনারপুর রিক্রিয়েশন ক্লাবের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডার, পুজোর মুখ সায়ন্তনী। ক্লাবকর্তাদের প্রস্তাবে প্রথমটায় হকচকিয়ে যান তরুণ আইনজীবী। এবারও যেন দুগ্গা মায়ের সচকিত হাসি চারিয়ে গেল সায়্ন্তনীর মুখে। পিঠে হাত রেখে মেয়েকে এগিয়ে যাওয়ার আশ্বাস দিলেন বীথিকাদেবী। গুটিগুটি পায়ে পুতুল দেশে পা রাখলেন, সোনারপুরের জ্যান্ত পুতুল। সমাজে থেকেও বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দার মতোই দিন কাটে রূপান্তরকামীদের। অন্তরে মেয়ে হয়েও বাইরে পুরুষের আবরণে মুড়ে থাকার যন্ত্রণা একমাত্র তাঁরাই জানেন। সেই য্ন্ত্রণা কাটিয়ে উঠে সুস্থ পরিবেশে স্বপরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লড়াইটা আরও কঠিন। সায়ন্তনী, সমস্ত রূপান্তরকামী সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে সেই লড়াইটা জিতে নিয়েছেন। আগে যেমন তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে পদে পদে অপমানিত হতেন, এখন সম্মাননায় ভাসছেন! সোনারপুর রিক্রিয়েশন ক্লাবের পুজোর মুখ সায়ন্তনী ঘোষ। তাঁর হাত দিয়েই, মা দুগ্গা চোখ মেলে তাকাবে। হ্যাঁ তিনিই এবার দুর্গা মায়ের চক্ষুদান করবেন। এবার সোনারপুর রিক্রিয়েশন ক্লাবের পুজোর থিম ‘এলেম পুতুল দেশে’। যেখানে ফেলে আসা মেয়েবেলা এখনও এক্কাদোক্কা খেলে। মাকে দেখতে এসে ফিরতেই হবে হারানো দিনগুলিতে। যেখানে মায়ের ভয়ে প্রাণপ্রিয় পুতুলকে লুকিয়ে রাখতে কতনা প্রাণান্তকর খাটুনি খাটতে হত। রেজাল্ট খারাপ হয়েছে, মা এবার পুতুল ফেলে দেবে। দেবীদর্শন সেরে বাড়ি ফিরে মেয়েবেলার সেই পুতুলখানি একবার খুঁজে দেখুন তো। জীবন নামক বহতা নদী অনেক বাঁক পেরিয়ে এলেও কোথায় যেন সেই মেয়েবেলা এখনও সজীব, চোখের জল আর ফিরে পাওয়ার আনন্দ সোনালী দিনগুলিকে মনে করাবে। আর এক ঝাঁক সায়ন্তনী হেঁটে চলে বেড়াবে সেই সেদিনের বেলাভূমিতে।
যেদিন ছোট্ট বোনের সঙ্গে দু’বছরের বড় দাদাও পুতুলবাড়ি খেলত। মনে মনে সেও যে সায়ন্তনীই হতে চায়, ক’জন তার খবর রাখেন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.