ছবি: অরিজিৎ সাহা
গৌতম ব্রহ্ম: ঘরে-বাইরে কালের দুই রূপ। বাইরে থমকে দাঁড়িয়ে। ভিতরে চলমান। ঘড়ির কাঁটার মতো। বাইরে টিকটিকির মতো ঝুলছে হাট করে খোলা টিনের তোরঙ্গ। মাল নেই, মালিকও নেই। দাবি নেই। দাবিদারও নেই। দাবিহীন তোরঙ্গের জঙ্গলে ঘুড়ির মতোই আটকে গিয়েছে সময়।
ভিতরে উলটো ছবি। ঘড়ির কাঁটার ছন্দে প্রতি মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে মণ্ডপ। বদলে যাচ্ছে আলো, আবহ, শামিয়ানা। আর বদলে যাওয়া সেই শামিয়ানার নিচে দিক বদলাচ্ছে দেবী দুর্গা। সময়ের হাত ধরে প্রহরে প্রহরে বদলে যাচ্ছে মণ্ডপের প্রতিটি গোলার্ধ। অনেকটা সেই নাজিম হিকমতের কবিতার মতো, ‘চেরির একই ডাল, একই হাওয়ায় দু’বার নড়ে না।’ মহাকালের এই বিপরীতমুখী স্রোত এবার নাকতলা উদয়ন সংঘের পুজোয় মণ্ডপবন্দি করেছেন সুশান্ত পাল। জানালেন, “সময়টাকে ধরা সম্ভব নয়। আমি ধরতে চাইছিও না। আমি সময়টাকে প্লে করছি। তৃতীয়া থেকে দশমীর প্রতিটি মুহূর্ত এখানে ধরা হবে। আলো বদলে যাবে। দৃশ্যপট বদলে যাবে। ফলে, কখনওই তা একঘেয়ে হবে না।”
সপ্তাহের সাতটা দিনের প্রতিটা মুহূর্ত একটা আরেকটার চেয়ে আলাদা। সময়কে আগে থেকে প্রেডিক্ট করা যায় না। কোনও একটা জায়গায় হয়তো এই মুহূর্তে একশো লোক। আবার তার কিছুক্ষণ পরেই কেউ নেই। এখন যা বর্তমান, কিছুক্ষণ পরেই তা অতীত। পুজোর উদ্বোধনে এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সেই কথা মনে করিয়ে দিলেন। পাশে নিয়ে বললেন, “আজ, কাল, পরশু নিয়েই তো সময়। জীবন তো থেমে থাকে না। কাজ করতে করতে কুড়ি-পঁচিশটা বছর পেরিয়ে যায়।” সময় নিয়ে একই উপলব্ধি পুজোর চেয়ারম্যান তথা রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের।
পরিবর্তনকে বাঙ্ময় করে তুলতে উদয়নের মণ্ডপে থাকছে একটি কাল্পনিক স্টেজ। সেখানে একটা অদৃশ্য চিত্রনাট্য তৈরি হবে। কিন্তু সেই চিত্রনাট্য নাটক সিনেমার মতো নয়। মাথায় পেল্লায় কালের কাঁটা নিয়ে তা প্রতি মুহূর্তে বদলে বদলে যাবে। পুজো কমিটির সাধারন সম্পাদক বাপ্পাদিত্য দাশগুপ্ত জানালেন, ‘‘যাঁরা ঠাকুর দেখতে আসবেন তাঁরা ভাবতেও পারবেন না কী সৃষ্টি চাক্ষুষ করে গেলেন। দুশো জন শিল্পী এখানে প্রতিনিয়ত পারফর্ম করবে। কিন্তু সেই পারফরম্যান্সের প্রতিটি অণু-পরমাণু আলাদা হবে। প্রতি মিনিটে মিনিটে সেই বদল টের পাবেন দর্শকরা। মণ্ডপের বাইরে থাকছে শিল্পী সুরজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের থিম সঙ্গীত।”
[ভালবাসার টানে মণ্ডপে, শহরের পুজোয় একাত্ম হয়ে গেলেন মার্কিন যুবক]
কুড়ি পঁচিশ জন এখানে মিউজিক অ্যারেঞ্জ করছে। কখনও বাঁশি শোনা যাবে, কখনও সারেঙ্গি, কখনও সেতার। যন্ত্রানুসঙ্গের সবটাই ‘লাইভ’ হবে। ভেতরে প্রতিমুহূর্তে একটা ঘড়ির শব্দ হবে। প্রতিটি কোনা দর্শককে বলে দেবে, কোন সময়ে সে এখানে এসে পৌঁছেছে।” উদয়নের মণ্ডপে ঢুকে আরও এক উপলব্ধি হবে। সেই শাশ্বত অনুভূতি। ‘আমিই সেই। আমিই সেই।’ সুশান্তবাবু জানালেন, “পৃথিবীর যখন প্রথম সৃষ্টি হল তখন তো মানুষও ছিল না, ঠাকুর ছিল না। আস্তে আস্তে মানুষ এল। একটা বিশ্বাস তৈরি হল। ধর্ম তৈরি হল। কল্পনার মধ্যে দিয়ে একটা অবয়ব তৈরি হল। তাহলে ঠাকুর বানালো কে? মানুষই তো বানালো। আমরা সেটাই তুলে ধরেছি।” উদয়নের প্রতিমা দুর্গার মুখোশ পরা মানবী। তার কোলে থাকছে শোলার তৈরি এক একচালা দুর্গা। এর অর্থ, মানুষ তাঁর অন্তর্নিহিত দেবত্বের অনুভবেই দেবতাকে গড়ে।
[মেয়েরাই ধারক, এ বার্তা নিয়েই মা আসছেন সোনাগাছিতে]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.