ছবিতে সোনাগাছির প্রতিমা।
শাম্মী আরা হুদা: পতিতাপল্লির মাটি ছাড়া মায়ের প্রতিমা হয় না। আর ওঁরাই কিনা মায়ের পুজোয় ব্রাত্য। ওঁদের দেখলেই আড়চোখের চাহনি বেড়ে যায়। বেড়ে যায় ইঙ্গিতে কথা বলাও। সোনাগাছি, নামটি কানে আসলে কেউ বা প্রসঙ্গ বদলাতে চায়, কেউ বা ঘৃণায় মুখ কুঁচকে সে স্থান থেকে সরে যান। সেই সোনাগাছির মহিলারাই এবার সানন্দে উমার আরাধনায় মাতলেন। সমাজ সংসারের সঙ্গে দীর্ঘ আইনি লড়াই করে গত বছরই পুজোর অনুমতি আদায় করে নিয়েছেন তাঁরা।
দিনগত পাপক্ষয়ের তাড়নায় এঁরা এই পেশায় মানিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন। তাইবলে আর পাঁচটি স্বাভাবিক মানুষের জীবনযাপনে আগ্রহ থাকবে না তাতো হতে পারে না।বর্ষা শেষে শরৎ এলে উমার আসার দিন ঘনিয়ে আসে। কিন্তু মাকে দেখতে মণ্ডপে যেতে পারেন না সোনাগাছির মেয়েরা। দেবীপক্ষে নারীশক্তির এই অবমাননা যেন সমগ্র নারীতত্বের অপমান। যোগ্য জবাব দিতে নিজেদের এলাকাতেই উমার আরাধনার সিদ্ধান্ত নেন যৌনকর্মীরা। তাতেও আপত্তি, পতিতারা করবে মায়ের পুজো? রে রে করে তেড়ে আসে সমাজপতিরা। বাধ্য হয়ে ছয় বাই সাত ঘরের মধ্যে পুজোর আয়োজন হয়। টানা তিনবছর এভাবেই পুজো হয়েছে। কিন্তু দুর্গাপুজো আর একটা ছয় বাই সাত ঘর, এ তো মাকে অপমান করা। এভাবে তো চলতে পারে না। প্রতিবাদে পুজো বন্ধ করে দিলেন সোনাগাছির যৌনকর্মীরা। ২০১৬-তে এপাড়ায় আরা উমার বোধন হল না। সমাজপতিদের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে প্রকাশ্যে পুজোর অনুমতি চেয়ে আদালতে যান প্রমীলা বাহিনী। সেখানেও জয়জয়কার। গত বছরেই মহামান্য আদালতের ছাড়পত্র মিলেছে। এবার তাই পাড়াতেই আট ফুট চওড়া ২০ ফুট উচ্চতার মণ্ডপ বেঁধে পুজোর আয়োজনে মেতেছেন যৌনকর্মীরা। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর জয় এসেছে। সোনাগাছির মহিলারদের জন্য তো কেউ মাটি ছেড়ে দেয় না। তাই লড়াইয়ে জিতে নেওয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর প্রমীলা বাহিনী। ইতিমধ্যেই কুমোরটুলিতে ঠাকুরের বায়না হয়ে গিয়েছে। মহিলা মৃৎ শিল্পী, টুম্পা, রুমাদের ঠাকুর তৈরি করছেন। তৃতীয়াতেই উমাকে নিয়ে আসা হবে মণ্ডপে। ওই দিনই সোনাগাছির এবারের দুর্গাপুজো উদ্বোধন। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে নেতামন্ত্রীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
পুজোর আয়োজন নিয়ে দারুণ ব্যস্ত দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির সম্পাদক কাজল বোস। তিনি জানান, খুব আনন্দ হচ্ছে। গোটা সমাজকে ধরে রাখে সোনাগাছি। ঘরেবাইরে আজ মহিলার নিরাপদে ঘুরে বেড়ানোর নেপথ্যে রয়েছেন এই পাড়ার মহিলারা। স্বয়ং মা দুর্গার প্রতিমা গড়তেও লাগে পতিতাপল্লির মাটি। আর তাঁরাই কিনা পুজোতে ব্রাত্য। নারী ছাড়া সমাজ মূল্যহীন, এই তত্ত্ব মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতেই সোনাগাছির পুজোতে মহিলারাই হর্তা কর্তা বিধাতা। কুমোরটুলির মহিলা প্রতিমা শিল্পী কাঞ্চি পাল যেমন ঠাকুর তৈরির বরাত পেয়েছেন। তেমনই মায়ের পুজোয় পৌরহিত্য করবেন মেদিনীপুরের শর্মিলা ভট্টাচার্য। মহিলা ঢাকিই মণ্ডপে থাকুন, এমনটাই চাইছেন সোনাগাছির যৌনকর্মীরা। তবে এখনও ঢাকির খোঁজ মেলেনি। নৈহাটিতে মহিলা ঢাকিদের আস্তানা। খবর মিলতেই শুরু হয়েছে খোঁজ। সন্ধান পেলেই বরাত দিতে দেরি হবে। ইতিমধ্যেই মণ্ডপ সাজানোর কাজে হাত লাগিয়েছেন মহিলারা। পুজোর কাজ ভাগাভাগির জন্য যৌনকর্মীরা নিজেদের মদ্যেই দল তৈরি করে ফেলেছেন। একদল মণ্ডপ সজ্জায় ব্যস্ত থাকবে। একদল কাটবে ফল। একদল মায়ের অবস্থানের জায়গা গোছগাছ করবে। একদল ভোগ রান্না করবে। একদল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকবে। সবমিলিয়ে প্রায় তিনহাজার মহিলা এই কর্মযজ্ঞে শামিল হয়েছেন। নিজেদের উপার্জনের বড় অংশই পুজোর বাজেট হিসেবে ধরা হয়েছে। তাই দিয়েই চলছে কাজকর্ম। তৃতীয়াতে পুজোর উদ্বোধন তাই শেষমুহূর্তের ব্যস্ততা সোনাগাছির মহল্লায়।
পড়ন্ত বেলায় উঠোনে চুল শুকিয়ে নিতে বসেছিলেন টুম্পাদেবী (নাম পরিবর্তিত)। ১৭ বছর বয়সে স্বামী নিজে সঙ্গে করে এনে সোনাগাছিতে রেখে গিয়েছিল তাঁকে। তারপর আর বাড়ি ফেরা হয়নি। এরমধ্যে কেটে গিয়েছে ১৮টি শরৎ। উমা এসেছে চলেও গিয়েছে, হইহই করে ঠাকুর দেখা, অঞ্জলি দেওয়া রয়ে গিয়েছে স্মৃতিতেই। এবার ফের পুজো এসেছে সোনাগাছিতে। বিয়ের আগের পুজোর স্মৃতি টুম্পার মনে ভিড় করে আসছে। তাইতো খুব আনন্দে রয়েছেন তিনি। পুজোর গোছগাছের মধ্যেই নিজের কেনাকাটাও সেরে ফেলেছেন। তিনখানা শাড়ি কিনেছেন। অনেকদিন মনের মতো সাজার সুযোগ মেলেনি। তাই পার্লারে গিয়ে চুল স্ট্রেট করিয়ে এনেছেন। মন হলেই বালিকাসুলভ হাসি নিয়ে মণ্ডপে ঘুরে আসছেন। মেয়েবেলার স্মৃতি তাড়া করে ফিরছে। ভোরের শিশির ভেজা শিউলি দেখলেই গুনগুনিয়ে উঠছেন। পুজোর সময় একদিন ছেলেকে নিয়ে আসবেন সোনাগাছিতে। স্বামী রোজগারের জন্য তাঁকে বেচে দিলেও ছেলেকে নিজের কাছেই রেখেছিল। বছরদুয়েক আগে স্বামী গত হয়েছে। ছেলে তাই টুম্পার জিম্মায়। কিন্তু পতিতাপল্লির যন্ত্রণাদীর্ণ জীবন ছেলের শৈশবকে কলুষিত করুক, টুম্পা চাননি। স্বামীর মৃত্যুর পর কিশোর ছেলের ঠাঁই হয়েছে হস্টেলে। মাকে নিয়ে তার অপার কৌতূহল। শিশুকে আর কতই বা প্রবোধ দেবেন। তাই পুজোতে আনবেন। দুর্গা মায়ের কাছে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে আশীর্বাদ চাইবেন। ছেলেকে বোঝাবেন, পৃথিবীর প্রতিটি মেয়েই মা দুর্গার সন্তান। সোনাগাছির যৌনকর্মীরা তার বাইর নন। তাই আর পাঁচজন মহিলার মতো তাঁদের সম্মান পাওয়ার অধিকার রয়েছে। মহিলাদের সম্মান করাটা পুরুষের অবশ্য কর্তব্য হওয়া উচিত। সেই কাজ মা দুর্গার সামনে নিজের ছেলেকে দিয়েই শুরু করতে চান তিনি।
দুর্বারের সদস্য পুতুলও পুজো নিয়ে মেতে রয়েছেন। বয়স কবে কুড়ি কুড়ি বছর পার করেছে হিসেব রাখেননি। সোনাগাছিতে বৃদ্ধাদের খুব একটা গুরুত্ব নেই। একমাত্র ছেলে আজ উপার্জন করছে। সংসারে আর্থিক সচ্ছলতা ফিরেছে। তবুও সোনাগাছিতেই রয়ে গিয়েছেন। কীসের টানে জানেন না। শুধু মানেন, তিনি থাকলে ছেলের ব্যক্তিজীবন বিপর্যস্ত হতে পারে। শুধু পুতুলের পায়ে নয়, সমগ্র সোনাগাছির পায়েই এক অদৃশ্য বেড়ি রয়ে গিয়েছে। তাইতো কলকাতার মধ্যে থেকেও বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো বসবাস পুতুলদের। রাতের সোনাগাছি অনেকের মনে রং ধরালেও দিনের আলোয় তাঁরা ব্রাত্যই থেকে যান। পুজো আসে পুজো যায়, বর্ণহীন বৃদ্ধের মতো এককোণে পড়ে থাকে সোনাগাছি। পতিতাপল্লির মাটিতে মৃন্ময়ী মা অবয়ব পান। পড়ন্ত বিকেলের কনে দেখা আলোয় পুতুলের মুখে ফুটে ওঠে বয়সের রেখা। কোথাও কুঞ্চিত অভিমান, কোথাও সঞ্চিত অপমান, কোথাও বা বঞ্চনা যেন জ্যামিতিক নকশায় বিস্তৃত হয়েছে। ঠৌঁটে লেগে থাকা মৃদু হাসি, জানান দিচ্ছে, লড়াই পেরিয়ে মা আসছেন সোনাগাছিতে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.