ছবিতে পাথরিয়াঘাটার ঘোষবাড়ির মা দুগ্গা।
পুজো প্রায় এসেই গেল৷ পাড়ায় পাড়ায় পুজোর বাদ্যি বেজে গিয়েছে৷ সনাতন জৌলুস না হারিয়েও স্বমহিমায় রয়ে গিয়েছে বাড়ির পুজোর ঐতিহ্য৷ এমনই কিছু বাছাই করা প্রাচীন বাড়ির পুজোর সুলুকসন্ধান নিয়ে হাজির Sangbadpratidin.in৷ আজ রইল পাথুরিয়াঘাটার রামলোচন ঘোষ বাড়ির দুর্গাপুজোর কথা।
ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়: সেই কবেকার কথা। আজও একইরকম ঐতিহ্য বহন করে চলেছে বনেদি বাড়ির পুজো। কত অজানা ইতিহাস কথা বলে পুজোর দালানে। কলকাতা, শহরতলি ও জেলায় ছড়িয়ে রয়েছে এমন বহু পুজো। আঠেরো শতকের শেষে রামলোচন ও তাঁর দাদা রামপ্রসাদ ঘোষের শুরু করা সেই পুজোর কাহিনি আজও শুনতে মন চায়।
সারা বছর যাঁর কাছারিতে কাজ করি, বাড়ির পুজোয় তাঁর পদধূলি পড়লে মনে ফূর্তি বেড়ে চতুর্গুণ হয়। সঙ্গে গর্বও। সেকালেও মন এমন অবশ হত। এমনিতে ছিল সবই বারোয়ারি পুজো। হতও হাতে গোনা। সম্পদ যা ছিল সবই বাড়ির পুজোর। আঠারো শতকের শেষে পাথুরিয়াঘাটার রামলোচন ঘোষ ও তাঁর দাদা রামপ্রসাদে মিলে বাড়িতে দুর্গাপুজোর প্রচলন করলেন। সালটা ১৭৮৩। এই রামলোচন ছিলেন বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংসের দেওয়ান। উল্টোরথে খুঁটি প্রণাম সেরে প্রথামতো পুজোয় বসেছিলেন দেওয়ান। লেই দৃশ্য দেখতে সস্ত্রীক এসেছিলেন হেস্টিংস। মাড়োয়ারি পাড়া সুতানুটিতে আগমনীর বাজনার দমক তখন দেখে কে! মহালয়ার স্নিগ্ধ ভোরের শিহরণ আরও তীব্র করতে সানাইয়ের সুর জুড়তেন পাথুরিয়াঘাটার সৌখিন জমিদার। পুজোর ক’দিনও এসে বাজিয়ে যেতেন সানাইবাদক। এখন পাথুরিয়াঘাটার বাড়িতে পুজোর আভিজাত্যে কোনও টান পড়েনি। বদলেছে কিছু অনুষঙ্গ। প্রতিমা গড়ার কাজও চলেছে বংশানুক্রমে। গঙ্গায় কালে কালে মাটি ধুয়ে গেলেও প্রতিমার যে মহিমা দেখে বড়লাট মুগ্ধ হয়েছিলেন, আজও তার রূপের আভাস পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরদালানে। মুখের কোনও পরিবর্তন হয়নি। মঠচৌরি শৈলীর চালচিত্রে থাকেন কালী, জগদ্ধাত্রী, কৃষ্ণ। পটুয়া বাড়ি এসে চালিতে পট লিখে দিয়ে যেতেন। সে কাজ এখন কাগজেই তোলা হয়।
[মায়ের নির্দেশে প্রথম সন্তানকে বলি দিয়েই ভগীরথপুরের চৌধুরিদের দুর্গাপুজোর সূচনা]
প্রবীণ এক সদস্য স্মৃতি হাতড়ে বললেন, বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই তোড়জোড় শুরু হত। বৈশাখ মাসে কাঁচা আম উঠলে তা কেটে নতুন কিছু মাটির হাঁড়িতে গুড়ের সঙ্গে মাখানো হত। সেই আমমাখা নতুন গামছায় ঢেকে রাখা হত। সেই মিশ্রণে পড়ত বিশেষ মশলাও। হত আমের কাসুন্দি। মিষ্টি হত ভিয়েন বসিয়ে। পেস্তার বরফি, কাঠবাদামের বরফি, মুগের বরফি, ক্ষীরের ছাঁচ, চন্দ্রপুলি, রসকরা, গুড়ের নারকেল নাড়ু। চন্দ্রপুলি তৈরির আবার বিশেষ নিয়ম ছিল। নারকেল বেটে, ক্ষীর আর চিনি
মিশিয়ে পিতলের কড়ায় জ্বাল দেওয়া হত। কাঠের হাতায় নেড়ে যেতে হত। তার পরে হাতে করে তা বানানো হত। ভেতরে থাকত বাদাম, পেস্তা আর মিছরির পুর। নৈবেদ্য দেখলেই চোখ কপালে উঠত। বড় থালায় দেবীর মূল নৈবেদ্যে ঠাঁই পেত প্রায় দু’মন চাল। সঙ্গে নানা ফল আর মিষ্টি। চালে নানা ধরনের ডাল, মশলা, পাঁচকলাই মিশত। ৩০ রকমের নৈবেদ্য হয়। শীতল ভোগে দেওয়া হয় লুচি, মিষ্টি আর চন্দনী ক্ষীর। নলিনচন্দ্র দাসের দোকানের সেই ক্ষীর এখনও আসে। সে সময় ছাদে প্যান্ডেল
খাটিয়েই চলত রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়া। ষষ্ঠী আর অষ্টমীতে হত নিরামিষ। নবমীর রাতে বিশেষ অতিথি সমাগম ঘটত। রান্না হত নানা পদ। তিন পদের মাছ, পাঁঠার মাংস, শেষ পাতে নানা ধরনের মিষ্টি। পরবর্তীকালে ঘোষ বংশের দুই সদস্য ভূপেন্দ্রকৃষ্ণ এবং মন্মথনাথ কলকাতার সঙ্গীত জগৎ মাতিয়েছিলেন সগর্বে। ‘অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্স’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ভূপেন্দ্রকৃষ্ণ। নবমী নিশি গভীর হত তাঁদের ধ্রুপদী গানের সুরে। শুধু সেই সন্ধ্যার আসর দেখতেই আসতেন দেশের
বহু খ্যাতনামা শিল্পী। কখনও সখনও বসত নাচের আসরও।
মহালয়ার পরের দিন শুক্লা প্রতিপদে দেবীর বোধন হওয়ার রেওয়াজ। প্রতিপদ থেকে নবমী রোজ হবে চণ্ডীপাঠ। আগে পুজো হত তালপাতার পুঁথি দেখে। সারা বছর লাল শালুতে মোড়া থাকত সেই পুঁথি। পাঁঠাবলির রেওয়াজ ছিল। কালে কালে সপ্তমী ও সন্ধিপুজোয় একটি করে চালকুমড়ো এবং নবমীতে দু’টি চালকুমড়ো ও আখ বলি দেওয়ার রীতি চালু হয়। দশমীর সকালে উড়ত নীলকণ্ঠ পাখি। নীলকণ্ঠ পাখি না থাকলেও রয়ে গিয়েছে কনকাঞ্জলির রীতি। রুপোর আশাসোঁটা, তরোয়াল নিয়ে বিসর্জনের
শোভাযাত্রা বেরত। আটজন বাহকের কাঁধে চেপে আজও প্রতিমাকে নিয়ে যাওয়া হয় নিরঞ্জনের ঘাটে। ঘাট থেকে আগে বজরায় চাপিয়ে মাঝগঙ্গায় নিয়ে গিয়ে প্রতিমা বিসর্জন হত। ঠমক কমলেও রীতিতে ফাঁক রাখতে চায় না ঘোষবাড়ি। প্রতিমা নিরঞ্জনে এখন দু’টি নৌকা ভাড়া নেয় ঘোষেরা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.