অষ্টমীতে মণ্ডপ দর্শনে উপচে পড়া ভিড়, ছবি : প্রবীর বন্দ্যোপাধ্যায়।
গৌতম ব্রহ্ম: বাগবাজারের গরদের শাড়ির চোরা চাউনিতে অঞ্জলির মন্ত্র ভুলেছে চল্লিশোর্ধ্ব নীল পাঞ্জাবি। অষ্টমী মানেই তো ‘প্রাণের আবেগ, প্রাণের বাসনা রুধিয়া রাখিতে নারি’। রাত পোহাতে না পোহাতেই সেই রেশ অব্যাহত নবমীতেও। রাতের ভিড় এড়াতে অনেকেই নবমীর সকালেই মণ্ডপ দর্শনে বেরিয়ে পড়েছেন। চোখে পড়ার মতো ভিড়। গোটা দিন এবং নবমী নিশি ঠিক কেমন যাবে, তার একটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে। যাঁরা অষ্টমীতে পাড়ার মণ্ডপে সময় কাটিয়েছিলেন, তাঁরা সকাল সকালই শহরের রাজপথে। কেউ বা রোদ্দুর চড়া হওয়ার আগেই উত্তরের মণ্ডপগুলির দর্শন সেরে নিতে চান। কেউ বা দক্ষিণ। সবমিলিয়ে নবমী নিশির আয়োজন প্রায় সম্পূর্ণ। ফের একবার জনজোয়ারে ভাসতে চলেছে কলকাতা। সকাল থেকেই শুরু প্রস্তুতি।
অষ্টমীর রাতেও পুজোর শহরে লাখো পায়ের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। আবেগের ফল্গুধারা বুকে নিয়েই মহানগরের শিরায় শিরায় বইল জনস্রোত। উত্তরে বাগবাজার থেকে দক্ষিণে ম্যাডক্স স্কোয়ার, জমিয়ে আড্ডা চলছে সর্বত্র। একডালিয়া এভারগ্রিনে সতেরোর শাড়ি এদিনও খুঁজেছে আঠারোর পাঞ্জাবিকে। ম্যাডক্স স্কোয়ারে পুজো দেখতে গিয়ে মন হারিয়ে এসেছে কত কলেজপড়ুয়া! পুজো মানেই তো প্রেম। মনের কথা আলগোছে বলে দেওয়া। সেলফির প্রত্যুত্তরে হোয়াটসঅ্যাপে ভেসে আসা কম্পমান হার্টের ইমোজি। ফেসবুকের দেওয়াল জুড়ে সেলফির দাপাদাপি।
সকালে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে শুরু। তারপর বেলা বাড়তেই তিথি মেনে সম্পন্ন হয় সন্ধিপুজো। আর তারপর অষ্টমীর দুপুরে খিচুড়ি ভোগ খেয়ে বেরিয়ে পড়া। এ পাড়া-ওপাড়া। গাড়ি ভাড়া করে, কিংবা পায়ে হেঁটে পুজো পরিক্রমা। কারও পছন্দ উত্তর কলকাতার সাবেকিয়ানা, তো কারও থিমে থমথমে দক্ষিণ। কারও আবার পছন্দ রাজবাড়ি বা বনেদি বাড়ির পুজো। কেউ আবার কুমারী পুজো দেখতে হাজির হয়েছেন বেলুড় মঠে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই ভিড় বাড়তে শুরু করেছে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে। পুজো পরিক্রমার সঙ্গেই চলেছে পেট পুজো। কবজি ডুবিয়ে ভূরিভোজ। চাইনিজ, মোগলাই, কন্টিনেন্টাল একাকার হয়েছে অষ্টমীর মোহনায়!
ভিড় সামাল দিতে হিমশিম খেয়েছে পুলিশ। কিন্তু দিনের শেষে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি লালবাজারের হাতেই উঠেছে। ওয়াচ টাওয়ার, ওয়াকিটকি, মোবাইল ভ্যান, নাকাবন্দির অস্ত্রে ভিড়ের জব্বর মোকাবিলা করেছে পুলিশ। পুজো কমিটিগুলির মধ্যে অবশ্য মিশ্র প্রতিক্রিয়া। পুরস্কার বিজয়ীদের মুখে চওড়া হাসি। অল্পের জন্য পুরস্কার হাতছাড়া হওয়ার যন্ত্রণায় মুখ কালো হয়েছে অনেকের।
‘তিতলি’ বিদায় নিয়েছে আগেই। তবু মনে কিছু শঙ্কা ছিল। কিন্তু সপ্তমীর সকালে ঝকঝকে আকাশ সব আশঙ্কা দূর করে দিয়েছে। আবহাওয়া দপ্তরও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, পুজোয় ঝড়-ঝঞ্ঝা, বৃষ্টির আর কোনও সম্ভাবনা নেই। অষ্টমীর দিনও সকাল থেকেই ছিল রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশ। পুজোর আনন্দকে উপভোগ করতে তাই সময় যত গড়িয়েছে, অষ্টমীর ভিড় তত বেড়েছে। শুধু কলকাতার পুজো কেন, অষ্টমীর সন্ধ্যায় জেলায় জেলায় মণ্ডপগুলিতেও উপচে পড়া ভিড়।
মঙ্গলবার রাত দশটা ১৩ মিনিটে অষ্টমী লাগে। ছাড়ে বুধবার দুপুর বারোটা ৪৯ মিনিটে। তাই সকাল থেকেই বারোয়ারি মণ্ডপগুলিতে শুরু হয় অঞ্জলি। ‘সর্বমঙ্গলা মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থে সাধিকে শরণ্যে ত্রম্বকে গৌরী নারায়ণী নমস্তুতে।’ পুরোহিতের অমোঘ মন্ত্রোচ্চারণ সকাল থেকেই ঘুরপাক খেয়েছে লাউডস্পিকারে। আট থেকে আশি মায়ের কাছে মাথা ঝুঁকিয়ে প্রার্থনা জানিয়েছে। বেলা বাড়তেই পুরোহিতরা সন্ধিপুজোর প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। সন্ধিপুজোর সময়কাল মাত্র ৪৮ মিনিট। অষ্টমী তিথির শেষ ২৪ মিনিট ও নবমী তিথির প্রথম ২৪ মিনিট।
এদিন বহু পুজো মণ্ডপেই সেলেবদের দেখা গিয়েছে। কেউ অঞ্জলি দিয়েছেন পাড়ার পুজোয়। কেউ আবার সন্ধিপুজো দেখতে গিয়েছেন। বড়িশা প্লেয়ার্স কর্নারে সন্ধিপুজো দেখতে গিয়ে ভক্তদের হাতে কার্যত ঘেরাও হয়ে যান সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। সেলফি তোলার ধুম শুরু হয়। ইচ্ছা থাকলেও তাই বেশিক্ষণ মণ্ডপে থাকা হয়নি মহারাজের। ছবির প্রচারে এদিনও বেশ কিছু মণ্ডপে গিয়েছে ‘কিশোর কুমোর জুনিয়র’ টিম। প্রসেনজিৎ-অপরাজিতাদের দেখতে উপচে পড়েছে ভিড়। অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিকের বাড়িতেও এদিন তারকা সমাবেশ।
অষ্টমীর অন্যতম আকর্ষণ কুমারী পুজো। কুমারীর মধ্যে মাতৃভাব প্রতিষ্ঠাই এই পুজোর লক্ষ্য। শাস্ত্রমতে কুমারীপুজোর উদ্ভব কোলাসুরকে বধের মধ্যে দিয়ে। বেলুড় মঠ-সহ রামকৃষ্ণ মিশনের প্রায় প্রতিটি শাখায় কুমারীপুজোর আয়োজন হয় এদিন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.