রক্তিম মজুমদার: মণ্ডপে দুর্গার মুখ দেখে সবাই আপ্লুত । মৃদু গুঞ্জনে ‘মা’ ডাক ধ্বনিত হচ্ছে চারপাশে । তার মধ্যে আচম্বিতে ফিসফিসানি কানে আসে। দঙ্গল বেঁধে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা সমবয়সি বন্ধুদের মধ্যে কেউ বলে উঠেছে, “এবারের পুজোয় যেন কোনও মেয়ের চোখে পড়ে যাই মা। একটু দেখো, মাগো…” ‘সব শেয়ালের এক রা’ দিয়েই, আমাদের পুজো শুরু হয়ে যেত।
আমাদের এলাকাটা চারটে ব্লকে ভাগ করা। পাড়ার মণ্ডপ যে ব্লকে, সেই ব্লক থেকে প্রধান আর একটি ব্লকের দূরত্ব বেশ খানিকটা। লজঝরে কালো-কালো অ্যাভন সাইকেল আর একঘেয়ে নীল রঙের জিনসের প্যান্ট পরা কতগুলো ছেলে, প্যাডেলের পর প্যাডেল ঘুরিয়ে যেত… আশার ছলনে ভুলি! মণ্ডপ থেকে মণ্ডপ, এক প্রতিমা থেকে আর এক প্রতিমা। সিংহভাগ নজর থাকত দর্শনার্থীদের দিকে।
মনে আছে, সেবার পুজোর সময় বৃষ্টি হয়েছিল। সপ্তমী না অষ্টমীর সকাল, সেটা এখন মনে করতে পারি না। তবে বৃষ্টিটা মনে আছে। আর মনে আছে, হঠাৎ চোখে পড়ে যাওয়া টুকটুকে লাল ছাতার তলায় দাঁড়িয়ে থাকা সরস্বতী প্রতিমাকে। সত্যিই সরস্বতী ঠাকুর! মনে হচ্ছে যেন মণ্ডপের মৃন্ময়ী, চিন্ময়ী রূপ নিয়ে ভক্তদের মাঝে নেমে এসেছেন। শুধু ছাতাটাই কিছুটা বিসদৃশ।
আমাদের মধ্যে বরাবরই একটু ডাকাবুকো ছিল সমরেশ। কোনওমতে সাইকেলটাকে স্ট্যান্ড করতে করতে ওই বলে উঠল, “পেয়েছি! মা দুর্গা এবার মুখ তুলে চাইলেন।” আমরা তো হাঁ। কী করতে চায় ছেলেটা? সমরেশ এক ছুটে ‘সরস্বতী’র সামনে। আমরাও পড়ি কি মরি করে একটু সম্মানজনক দূরত্বে।
“তোমাকে এর আগে ঠিক কোথায় দেখেছি বলো তো?” সপ্রতিভ সমরেশ।
“কেন? তোমাদের স্কুলে।” চটজলদি জবাব ।
”আমাদের স্কুলে? বয়েজ স্কুলে? কবে?”
”এই বছরের শুরুতে। সরস্বতী পুজোয়। কেন, বাবার স্কুলে মেয়ে যেতে পারে না বুঝি?”
“তো-তোমার বাবা! মানে?” সমরেশ তোতলাচ্ছিল।
মেয়েটার হাসিখানা মিষ্টি। “তোমাদের অঙ্কের মাস্টারমশাই। তারাপদ স্যার…”
তারাপদ বাগ! আমরা আড়ালে বলতাম, তারাপদ বাঘ! কষ্ট করে কান পাতলে, কখনও কখনও হৃদয় ভাঙার শব্দও শোনা যায়…
আজ আমার ছেলে বড় হয়েছে। আমি বুঝি, ঠিক এই মুহূর্তে ওর মনে অনেক পরিকল্পনার কুঁড়ি। সপ্তমী থেকে দশমী, বৃষ্টি হোক বা না হোক, ওর মাথা খুঁজে পাওয়া যাবে ওর বন্ধুদের এক মাথা ভিড়ে। হয়তো বা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। অথবা লেখা হবে নতুন ইতিহাস! তবে এই প্রজন্ম কি ফেলে আসা সেই সময়কে ফিরিয়ে আনতে পারবে? নাকি দুর্গাপুজোর মুহূর্তগুলো মুঠোফোনে বন্দি হয়েই থেকে যাবে?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.