সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: শহর কলকাতার বয়স ৩০০ বছর পেরিয়েছে। অলিগলিতে কান পাতলে শোনা যায় ইতিহাসের গল্প। শুধু যুদ্ধ, ইংরেজ, স্বাধীনতার নয়, একদা জঙ্গল ঘেরা এই জায়গার আনাচে-কানাচে লুকিয়ে মা কালীর অলৌকিক গল্প! তার সঙ্গে যুক্ত ভক্তদের বিশ্বাস। আজকের প্রতিবেদনে রইল এমনই তিন কালীবাড়ির সন্ধান।
পুঁটে কালী: গঙ্গা তীরবর্তী বড়বাজার অঞ্চলের পোস্তা বাজার এলাকায় রয়েছে পুঁটে কালী মন্দির। কথিত প্রায় ৫০০ বছর আগে হুগলির ভুরশুটের বাসিন্দা তন্ত্রসাধক ‘রাজামানিক’ অর্থাৎ মানিকচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে গোলপাতার ছাউনি দিয়ে গড়ে ওঠে মন্দির। মন্দিরে ‘পঞ্চমুণ্ডির আসন’ পেতে দেবীর পুজো শুরু করেন মানিক! তবে এক্ষেত্রেও দ্বিমত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, মানিকচন্দ্র নন তাঁর বংশধর খেলারাম এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
এই কালীর নাম নিয়েও অনেক মত হাওয়ায় ভাসে। একটি পক্ষ মনে করেন, দেবী মূর্তির উচ্চতা কম হওয়ায় ‘পুঁটে’ বলা হয়। অপর একটি পক্ষের মত, খেলারাম একদিন মায়ের হোম করছিলেন। সেই সময় গঙ্গার খাল থেকে একটি পুঁটি মাছ হোমের আগুনে লাফিয়ে পড়ে। অর্ধদগ্ধ মাছটিকে খেলারাম জলে ভাসিয়ে দেন। এর পরই সেই মাছটি নাকি বেঁচে ওঠে! সেই থেকেই এই দেবীর নাম হয় ‘পুঁটি কালী’। পরে সেই ‘পুঁটি’ নামটিই লোকমুখে ‘পুঁটে’ হয়ে যায়।
মন্দিরে সারাবছর দেবী তন্ত্রমতে পূজিত হন। দিপান্বিতা অমাবস্যার দিন মাকে ভৈরবরূপে আরাধনা করা হয়। কালীপুজোর পরের দিন মন্দিরে হয় কুমারী পুজো এবং অন্নকূট উৎসব।
‘পুঁটে কালী’র ভোগেও রয়েছে অভিনবত্ব। জানা যায়, ‘পুঁটে কালী’কে নিরামিষ এবং আমিষ, দুই ধরনের ভোগই দেওয়া হয়। নিরামিষ ভোগে থাকে খিচুড়ি, পোলাও, লুচি, দুরকমের সবজি, চাটনি, পায়েস। আমিষ ভোগে দেওয়া হয় পুঁটি, রুই, বোয়াল, ভেটকি, ইলিশ মাছ। এই কালীর আর একটি বিশেষত্ব হল, মাতৃ প্রতিমার পাশেই রয়েছেন শীতলা। কালীর সঙ্গে শীতলা পুজোরও রীতি রয়েছে।
বামনদাস কালীবাড়ি: ঘোর ইংরেজ আমল। ১৮৯৪ সালে কাশীপুর অঞ্চলে এক ইংরেজের থেকে একটি বাড়ি কেনেন কয়লা ব্যবসায়ী বামনদাস মুখোপাধ্যায়। বেশ কিছু বছর পর ১৯০৪ সালে ৩৫ বিঘা জমির একধারে মা কালীর মন্দির তৈরি করেন তিনি।
পরিবার ও স্থানীয়দের থেকে জানা যায়, কয়লা ব্যবসায় বিপুল লাভ করেছিলেন ব্যবসায়ী বামনদাস। মা কালীর আরাধানার ইচ্ছা তাঁর মনে ছিল। তবে বিভিন্ন কারণে তা হয়ে উঠছিল না। এর মাঝেই তিনি দেবীর স্বপ্নাদেশ পান। ব্যস! দেরী না করে পুজো শুরু করেন বামনদাস। এখানে মাকে কৃপাময়ী কালীরূপে পুজো করা হয়। মায়ের ভোগে দেওয়া হয় নিরামিষ ভোগ।
পাড়ার বাসিন্দাদের দাবি, পুজোর রাতে মন্দিরের চূড়ায় বসে এক বাচ্চা মেয়েকে পা দোলাতে দেখেছেন তাঁরা। বাসিন্দাদের বিশ্বাস মা কালী ওই রূপে এসে বসে থাকেন। এতবছর পেরিয়ে পুজো বহরে কমেছে। তবে মায়ের পুজো আজও পুরনো নিয়ম মেনেই হয়।
এছাড়া, কাশীপুরের এই কালী মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে রঘুডাকাতের নাম। জানা যায়, তিনি এই এলাকায় আসতেন, মায়ের আরাধনাও করতেন। মন্দিরের আসতেন স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। জড়িয়ে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, মদনমোহন মালব্য ও বিধানচন্দ্র রায়ের মতো স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নাম। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৩৯ সালে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁকে এই মন্দিরে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
শ্যামসুন্দরী মন্দির: শিয়ালদহ স্টেশন থেকে সুকিয়া স্ট্রিট ধরে রামমোহন সিনেমা হলের পিছনেই শ্যামসুন্দরী মায়ের মন্দির। কথিত, কোনও ভক্ত মায়ের কাছে কিছু মানত করলে দেবী নাকি খালি হাতে ফেরান না।
চালকলা মায়ের মূল প্রসাদ। মন্দিরে কোনও বলি দেওয়া হয় না। কথিত, এলাকার ব্যবসায়ীদের মা স্বপ্নাদেশ দেন। সেই অনুযায়ী ভক্তরা মায়ের প্রয়োজনীয় জিনিস এনে দেন। সারাবছরই মায়ের পুজো হয়।
প্রতিদিনই মাকে ফুলের সাজে সাজানো হয়। সঙ্গে রয়েছে সোনার গয়না। দেখে মনে হয় মা যেন হাসছেন। ভক্তদের কাছে দেবী যেন করুণাময়ী!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.