অরুণিমা রায় চৌধুরী: জীবন ছিল সরল। সে জীবনে প্রাপ্তির আনন্দ ছিল, অপ্রাপ্তির দুঃখ তেমন ছিল না। পুজোর স্মৃতি ফিরে আসে একচালা মাতৃপ্রতিমা, ঘরের মেয়ে উমা’কে ছুঁয়ে। আর আসে সেই কিশোরী বয়েসের পুজোর ছেঁড়া ছেঁড়া স্মৃতি।
চারদিনের আনন্দোৎসব শেষ। ফাঁকির রেশ তখনও বিদ্যমান। বিদ্যাকে পাশ কাটিয়ে লক্ষ্মীপুজো অবধি টেনে দেওয়া যাবে পুজোর রোশনাই। তবুও, বিজয়া দশমীর সকালটা অল্প অল্প মন খারাপ করে দিত। মায়েরা তৈরি হত বরণে, আর আমরা লোভ না-সংবরণে।
মা শিখিয়েছিল, বিসর্জন নয়, প্রতিমা নিরঞ্জন। নিরঞ্জন না হলে বিজয়া দশমী হয় না। শেষের সে সকালে প্যাণ্ডেলে আমাদের কুচোদের মিটিং হ’ত Eating slot-এর। নিরঞ্জনের পরেই মাহেন্দ্রক্ষণ শুরু। পাড়ার কাকিমা-জ্যেঠিমাদের বাড়ি বাড়ি ঘোরা। নবমীর দিন সকালে বাবা ভুট্টা নিয়ে আসত। লক্ষ্মীপুজোয় মা বেশ একটা ভুট্টা-ঘুগনি করত। বেনজির সেই ভুট্টা! পুজো স্পেশাল মেনু। আমার অবশ্য জিভ টানত আয়েশাদের বাড়ির সরস মোয়ায়। কাকিমা বানাতেন কিছু কাঁচা কিছু ভাজা! কাকিমা জানতেন আমার সরস প্রীতি। তাই বরাবর আমার ভাগের ভাগ্য ছিল বেশি। কিছু পেটে, কিছু প্যাকেটে।
মা যেমন আর অন্য কোনও সময় বানাতো না এই ভুট্টা-ঘুগনি, তেমনই কাকিমাও শুধু পুজোর সময়েই বানাতেন এই সরস মোয়া। শুধু যে বছর চলে গেলেন সেবারই ঘন বর্ষায় হঠাৎই একদিন ডেকে নিলেন কাকিমা। আর গোপনে পাচার করে দিলেন কলেজছাত্রীর ব্যাগে, ভালোবাসার নিষিদ্ধ ইশতেহার সেই সরস মোয়া। তুমিও কি জানতে কিছু কাকিমা?
রেসিপি শিখিয়েছিলেন কাকিমা। কীভাবে নারকোল কুড়োতে হয়, অল্প চিনি দিয়ে মেখে, মণ্ড কীভাবে…‘ইঁচা মানে চিংড়ি, মাথাটা আমরা করি সেই চিংড়ির মাথার মতো, তাই ইচার মুড়া।’
কাকু মজা ক’রে বলতেন, ছোঁচার মোয়া। সেই কাঁচা সরস মোয়া ঘিয়ে ভেজে, ছেঁচে নেওয়া… সেই বর্ষাতেই শেখা আর সেই বর্ষাতেই শেষ। স্মৃতি সততই সুখের কী না জানা নেই। এটুকু জানি, আমার সময় পালটে গেছে দ্রুত। যা ছিল বাড়ির কাকিমা-জ্যেঠিমাদের হাতে তৈরি নাড়ু-মোয়া এলোজেলোর যুগ, সেখান থেকে পেরিয়ে আজ দোকানে থরে থরে সাজানো দেখি, ভিড়ও দেখি, ভিরমি খাই। সে খাওয়ায় আদরের ছোঁয়া নেই, কাকিমারা নেই, আমার বন্ধু আয়েশার আম্মি নেই।
সরস মোয়া দেখিনি আর। মা জানেন আমার গোপন দুর্বলতা। তাই মাও কোনওদিন করেননি সরস মোয়া। কাকিমা শিখিয়েছিল যে বর্ষায়, যে শরতের আগমনীতে আমাদের পাড়ায় আলো জ্বলেনি সেভাবে, আমিও আর কোনওদিন বানাতে পারিনি কাকিমার সেই শেখানো।
কিছু খাবার স্মৃতিতে জুড়ে থাকে। স্মৃতিসুধারসকণাই ভবিতব্য তার। পুজোর খাবার, যা কোনওদিন আর আমার কাছে ফিরবে না। সেই সরস মোয়া বেঁচে থাকুক বাঙালির প্লেটে পেটে। আমাদের মায়েদের হাতে তৈরি, কুড়োনো নারকেল, অল্প সুজি, অল্প চিনি, অনেকটা আদর, অনেকটা স্নেহ – ভালোবাসায় ভেজে উঠুক জীবন, ভিজে যায় চোখের কোল।
আয়েশা আজ দূর দেশে। আমার সরস-মোয়া মোহের সাথে পাল্লা দিত ওর ভুট্টা-ঘুগনি প্রীতি। মা এখনও বানায়, আয়েশা আসবে করেও আসে না। মা, মায়েরা অপেক্ষা করে চিরকাল…একলা, তাঁর সন্তান এই আনন্দোৎসবে ফিরবে না জেনেও। উমা, একলা হয় আরও…একলা হয়, আমার স্মৃতিমাধুরীর কণা!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.