অন্তরা বন্দ্যোপাধ্যায়: কাজু ও কিশমিশ সামান্য ঘি দিয়ে ভেজে আলাদা রাখতে হবে। সেদ্ধ মাংসগুলি ছোট ছোট টুকরো করে নিতে হবে। হাঁড়িতে মাংসের টুকরোগুলোর সঙ্গে এক চামচ ঘি এবং সমস্ত মশলা (নুন, চিনি, গরম মশলা গুঁড়ো, টমেটো বাটা, আদা বাটা) মাখিয়ে খুব ভালো করে কষিয়ে নিতে হবে। মাংস থেকে তেল ছেড়ে গেলে আঁচ বন্ধ করে ধুয়ে রাখা গোবিন্দভোগ চাল মাংসের সঙ্গে আলতো হাতে মিশিয়ে দিতে হবে। এবার চালের পরিমাণের দ্বিগুণ জল দিয়ে চাপাঢাকা দিয়ে ঢিমে আঁচে রান্না হতে দিতে হবে চাল সেদ্ধ হওয়া পর্যন্ত। এক্ষেত্রে এক বাটি চাল দিলে দু’বাটি জল, এই পরিমাপটি মাথায় রাখতে হবে। চাল সেদ্ধ হয়ে গেলে আঁচ বন্ধ করে ওপর থেকে গোলাপ জল, দুধে ভেজানো কেশর আর আগে থেকে ভেজে রাখা কাজু-কিশমিশ দিয়ে আবারও চাপা দিয়ে রাখতে হবে কিছুক্ষণ। কিছুক্ষণ পর ঢাকা খুলে ওপরে থেকে আরও এক চামচ ঘি ছড়িয়ে দিতে হবে। এবার চালটি ঝরঝরে হয়ে গেলেই অপেক্ষার অবসান। তৈরি পাঁঠার মাংসের পোলাও।
প্রতিবছর নিজের হাতে নবমীর দিন এই পদটি রান্না করতেন আমার ঠাকুমা। পৌরহিত্যের পর আমার দাদুর ভাগে যতটুকু মাংস নির্ধারিত হত, তা দিয়েই ঠাকুমা এই পদটি তৈরি করতেন। সীমাহীন অভাবের সংসারে তিন ছেলেমেয়ের আহার জোগাড় করা তাঁদের পক্ষে দুঃসহ ছিল। তাই নবমীর দিন এই মাংসের পোলাওকে কেন্দ্র করে সকলেরই উৎসাহ ছিল চূড়ান্ত। আমার দাদুর প্রিয়তম পদটি ছিল তাঁর স্ত্রীর হাতের এই মাংসের পেঁয়াজ-রসুনবিহীন পোলাও। ঠাকুমাও অত্যন্ত নিষ্ঠাভরে রান্নাটি সম্পন্ন করতেন এবং পরম যত্নে সাজিয়ে দিতেন তাঁর স্বামী ও সন্তানদের পাতে। সকলের পরিতৃপ্তি দেখে ঠাকুমার ভিতরে ভিতরে নারীত্বের গর্ব ঝলসে উঠত।
বলা বাহুল্য, এই পদটি আমার ঠাকুমার কোনওদিনই চেখে দেখার সুযোগ হয়নি। সামান্য মাংসের ভাগ, তা ছেলেমেয়েদের মুখে তুলে দিতে না দিতেই নিঃশেষ হয়ে যেত। চিরন্তন বাঙালি মায়ের স্বভাবধর্মে ঠাকুমাও আজীবনে নিজের জন্য কিছুই করেননি। অতঃপর আমার দাদু চলে গেলেন। মাত্র একুশ বছর বয়সেই আমার ঠাকুমার বৈধব্যদশার সূচনা হল। এবার তিনি সম্পূর্ণ নিরামিষ আহার এবং সাত্ত্বিক জীবনাচরণ শুরু করলেন। নিরামিষ, আমিষের হেঁশেল হলো আলাদা। ঠাকুমার কড়া শাসনে, এঁটো-সকড়ির একটুও এদিক ওদিক হওয়ার জো থাকল না। দিনে তিনবার স্নান, একবার মাত্র স্বপাক আতপ চালের ভাত এবং একাদশী পালন হল তাঁর চিরসঙ্গী। খেতে বসলে ঠাকুমার পাশ দিয়ে কেউ হেঁটে গেলে, তিনি চিল চিৎকারে পাড়া মাথায় করেন। ছেলেমেয়েরা কোনও কারণবশত তাঁর ব্যক্তিগত জলের কুঁজোটি ছুঁয়ে ফেললে তৎক্ষণাৎ তিনি সমস্ত জল ফেলে দিয়ে পুনরায় কলসিটি ভরে আনেন। পাশাপাশি, ঘরে উদয়াস্ত গোবরজলের ছিটা দেন। অথচ ছেলেমেয়েদের আব্দারের মুখে পড়ে প্রতি বছর এই নবমীর দিনটিতে তিনি বিশেষ পোলাওটি রাঁধতে বাধ্য হন। এবং রান্না শেষে ঘরভর্তি লোকেদের শাপ-শাপান্ত করে ঘড়া ঘড়া গঙ্গাজলে স্নান করেন। এভাবেই দিন কাটতে থাকে।
ততদিনে ঠাকুমার বয়স অনেকটাই বেড়েছে। পাল্লা দিয়ে শরীরে বেড়েছে নানান রোগ। তাঁর খাদ্যতালিকা থেকে তিনি প্রায় বেশিরভাগ খাবারই আমিষ আহার বলে পরিত্যাগ করেছিলেন। তাই তাঁর শরীরটি ক্রমাগত জীর্ণ এবং রোগার্ত হয়ে পড়েছিল সহজেই। ইতিমধ্যে ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু তাঁরা কেউই ঠাকুমাকে হাসপাতালে যেতে রাজি করাতে পারলেন না। ঠাকুমার এক গোঁ—“মেলেচ্ছের ছোঁয়া জল” তিনি কিছুতেই খাবেন না। বিধর্মী মানুষের স্পর্শের থেকে প্রাণবিয়োগ তাঁর কাছে অধিকতর প্রিয় বলে প্রতিপন্ন হল। অগত্যা ছেলেমেয়েরা হাল ছাড়তে বাধ্য হলেন।
আরও বেশ কয়েকমাস পেরিয়েছে। ঠাকুমা একেবারে মৃত্যুশয্যায় মিশে গেছেন। অথচ সামান্য জলটুকু ছাড়া তাঁকে আর কিছুই প্রায় খাওয়ানো যাচ্ছে না। ডাক্তারবাবু ঘরে এসে দেখেছেন ঠাকুমার হৃদস্পন্দন। মাথা নাড়িয়ে ডাক্তারবাবু বলছেন, “কিছুই করার নেই। উনি যা চাইছেন আপনারা তাই করুন, কাউকে দেখতে চাইলে খবর দিন। একেবারে শেষ সময় এসে পৌঁছেছে।”
ডাক্তারবাবুর কথা শুনে ঠাকুমার মাথার কাছে আমার বাবা, পিসিরা ঠায় বসে থাকলেন। বারেবারে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, কিছু খেতে চান কি-না, কাউকে দেখতে চান কি-না। ঠাকুমার জিভ ততক্ষণে জড়িয়ে গেছে। অস্পষ্ট স্বরে কিছু বলছেন। কী বলতে চাইছেন, একেবারেই বোঝা যাচ্ছে না। ঠাকুমাকে আমার পিসি উচ্চঃস্বরে জিজ্ঞেস করছেন, “মা, কিছু খাবে, খিদে পাচ্ছে মা?”
ঠাকুমা আবারও যেন কিছু একটা বলে উঠলেন। কিন্তু সেই মৃদু এবং আড়ষ্ট কন্ঠ কিছুতেই শুনতে পেলাম না আমরা। পিসি উদ্বিগ্ন হয়ে ঠাকুমার মুখের কাছে কান এগিয়ে নিয়ে গেলেন। পিসি শুনতে পেলেন ঠাকুমা তখন বিড়বিড় করে বলছেন, “কতবার করে বললাম, আমায় একটু পাঁঠার পোলাও খাওয়াবি, অকালকুষ্মাণ্ড ছেলেমেয়েরা কিছুতেই তা খাওয়ালে না গা! কিছুতেই খাওয়ালে না!”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.