হামিরউদ্দিন মিদ্যা: পুজো(Durga Puja 2024) এসে গেছে। আকাশে বাতাসে একটা খুশি খুশি ভাব। প্রকৃতিও দুহাত মেলে নিজের ডালি সাজিয়ে আগমন জানাচ্ছে মা দুর্গাকে। তাই তো নদীর দুই পাড়, ছোট ক্যানেল, নববধূর সীতাহারের মতো সরু লিকলিকে দহিজুড়ির নালা, পাখমারার ডাঙা, মোষমরার চর সব জায়গাতেই কাশফুলের মেলা বসে গেছে। চারিদিক সাদায় সাদা, চোখ জুড়িয়ে যায়।
আমাদের গ্রামটি ছোট। গরিবগুর্বো মানুষদের বাস। দুর্গাপুজো হয় না। এখানে দুর্গার থেকে তার ছেলেপুলেদের কদর বেশি। কার্তিক, স্বরস্বতী, লক্ষীর পুজো হয় ঘটা করে। কামারপাড়া, লোহার পাড়া, রায়পাড়া, বাগদিপাড়ার মানুষজন, ছেলে-ছোকরারা ডিজে বক্স বাজিয়ে, সারা গ্রাম থরহরি কম্প করে ধুমধাম করে পুজো করে। আর হয় মনসাপুজো। বন-জঙ্গল, নদী-নালা, মাঠ-ঘাট নিয়ে এখানের গাঁ-গ্রামের মানুষদের বেঁচে থাকা। প্রাণ হাতে নিয়েই জল-জঙ্গল চষে বেড়াতে হয়। কাজপাট করতে হয়। তাই মা মনসাকে সবাই সন্তুষ্ট রাখে। তাকে সন্তুষ্ট না রাখলে যে বিপদ!
দুর্গাপুজো হয় একটু উন্নত গ্রামগুলোয়, আশপাশের মফঃস্বল শহরগুলোয়। পাশের গ্রাম মৌলা, রামপুর, ধুলাইয়ে দেখার মতো পুজোমণ্ডপ হয় বছর বছর। পুজো উপলক্ষে বিশাল মেলা বসে রামপুরে। আমন রোয়ানোর পর বর্ষার মেঘ কাটতে না কাটতেই রামপুরের মেলা দেখতে যাবার জন্য আমাদের দিন গোনা শুরু হয়ে যেত। মেলা বলতে তো সেই পৌষ পরবে গ্রামের মাঠে পীরপুকুরের মেলা, দুর্গাপুজোয় রামপুরের মেলা, আর চৈত্র সংক্রান্তিতে গাজনের মেলা।
আমার বাবা একটু নামাজি মানুষ। আগে খুব ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিল। কথায় কথায় হাদিস আওড়াত, আর নানান বাধা-নিষেধ চাপিয়ে দিত। নিজেও কোনও মেলায় যেত না। এমনকী হালখাতায় পাওয়া কোনও ক্যালেন্ডারে যদি পশুপাখি বা মহান মানুষের ছবি থাকত, তাহলে সেটা উলটে রাখত। পরে মক্কা-মদিনার ছবিওয়ালা ক্যালেন্ডার পেলে সেটা টাঙিয়ে দিত। জীবজন্তুর ছবি বা মূর্তি থাকলে ঘরে নাকি ফেরেশতা ঢোকে না। ফলে আর পাঁচটা ছেলেপুলে যেখানে বাবার সাইকেলের রডে কিংবা পেছনের ক্যারিয়ারে বসে মেলা দেখতে যেত, মণ্ডপে মণ্ডপে ঠাকুর দেখে আসত, আমার সেই সৌভাগ্য হয়নি। তবে মেলার সময় ঘরে মনখারাপ করে বসে থাকতে হত না। আমার দাদু ছিল ঘরের হেড। তার এক ধমকে প্রত্যেকটা বাপ-চাচায় থর-থর কাঁপত। বাবা বলত, ঠাকুর দেখা পাপ খোকা, সেরেকি গোনাহ। ধান কাটা হোক, পৌষ পরবে পীরপুকুরের মেলা যাবি। আর তো মাস কতক পরেই মেলা।
দাদু ধমক দিয়ে উঠত, রাখ তুর হাজিগিরি। ছোট ছেলে, পাড়ার সবাই যাচ্ছে, দেখে ওর কি মন খারাপ হবে না? নিশ্বেস ফেলবে না? উ কি পুজো করতে যাচ্ছে! চোখে দেখবে, মেলায় ঘুরবে, খেলনাপাতি কিনবে, জিলিপি খাবে। তাতে সমস্যা কী! তুর হাদিস তুর কাছেই রাখ, বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোর মাথায় ওসব জিনিস ঢুকাস না। দাদুর মুখের ওপর কিছু বলার সাহস বাবার ছিল না। মুখটা নামিয়ে চুপচাপ সরে পড়ত।
পরক্ষণেই ছোটকাকাকে হাঁক পাড়ত দাদু– রহিম, কুথায় গেলি বাপ! নাতি-নাতনিগুলোকে নিয়ে একবার ঠাকুর দেখিয়ে আন। কী মজাই না হত! ছোট ছোট ভাইবোনরা সবাই মিলে হেঁটে হেঁটে কাকার হাত ধরে পুজোর মেলা দেখতে যেতাম। যাবার পথেই পড়ত পাত্রহাটির মন্ডপ, সেটা দেখে রামপুর। রামপুরেই দুটো বিশাল বিশাল মণ্ডপে পুজো হয়। প্রতিবছর চমক লাগানো থিম। অনেকবার ব্লকে, জেলায় ফার্স্টও হয়েছে।
কাকার হাত ধরে ভিড়মিড় ঠেলে যখন দুর্গাপ্রতিমার সামনে দাঁড়াতাম, কেন জানি মনে হত আমাদের গ্রামের শেখপাড়ার আবদুলের মাকে দেখছি। তেমনই চোখমুখ, সেই নাক, সেই চাহনি। নসুচাচা নেশাভাং করে এসে চাচিকে খুব মারধর করত৷ চাচির সাতকুলে কেউ ছিল না। বাপের বাড়ির অবস্থাও ভালো না। ছোট ছেলে আবদুলের মুখপানে চেয়ে পড়ে পড়ে মার খেত। আবদুল ছিল আমার বন্ধু। স্কুল গেলে ডাকতে যেতাম। ওদের বাড়ির পাশ দিয়েই স্কুল যাবার পথ।
একদিন আবদুলকে ডাকতে গিয়ে দেখি নসুচাচা একহাতে চাচির চুলের মুঠি, আর এক হাতে গলাটা চেপে ধরে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে একেবারে সেঁটে দিয়েছে, চোখ বের হয়ে যাবার জোগাড়। আমি ভয়ে কঁকিয়ে উঠেছিলাম। সেই চিৎকার শুনে পাশের বাড়ি থেকে নিয়ামুল কাকা এসে উদ্ধার করেছিল আবদুলের মাকে। সেই ঠিকরে বেরনো চোখদুটো এখনও আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। কী অপরাধ ছিল আবদুলের মায়ের! কেন এমন করে মারত আবদুলের বাপ! আজও জানতে পারিনি। পরে গলায় দড়ি দিয়ে বাড়ির পেছনে কাঠাল গাছটাই ঝুলে পড়েছিল। আবদুল বড় হয়ে আর গ্রামে ফিরেনি, তার বাপ আবার বিয়ে করেছিল, সৎ মায়ের কাছে মন টেকেনি তার। ওই ঘটনার পর থেকে যতবার মণ্ডপে গিয়ে দুর্গাপ্রতিমার সামনে দাঁড়াই, আমার খালি আবদুলের মায়ের মুখটাই ভেসে উঠে। মনে হয় কেউ যেন চাচির চোখদুটো তুলে দুর্গাপ্রতিমায় বসিয়ে দিয়েছে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারতাম না ছোটতে, একটা অজানা ভয়ে কাকাকে জাপটে ধরতাম। কাকা বলত, ভয় কী খ্যাপা? মাটির ঠাকুর, কিছুই করবেকনি, আয় আমার কোলে চেপে দেখ।
ঠাকুর দেখা হলে মেলায় ঘোরাঘুরি। সস্তার ডুগডুগি, বাঁশি, বেলুন নেবার জন্য বায়না ধরতাম খুব। কাকা প্রত্যেককে একটা করে খেলনা কিনে দিত। তার পর খাওয়া দাওয়া সেরে বাড়ি ফিরতাম। কিন্তু মন আমাদের পড়ে থাকত সেই মেলায়। অমুক গাড়িটা কেনা হল না, অমুক জিনিসটা খাওয়া হল না। সেই না পাওয়াগুলোই আমাদের সামনের আরও একটা বছরের জন্য অপেক্ষা করতে শেখাত।
এখন গ্রাম-বাংলা বদলে গেছে। বদলে গেছে মানুষজনের মন। বদলে গেছে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানও। এখন সবই উৎসব। প্রত্যেক পুজোপার্বণেই আমার বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে আমন্ত্রণ পাই। বাড়ি গিয়ে খেয়ে আসি পাত পেড়ে, আমাদের ইদ, বকরি ইদের সময়েও আমন্ত্রণ করি কাছের বন্ধুবান্ধবদের। আমার বাড়িতে এসেও পেটপুরে খেয়ে যায় লাচ্ছা, সেমাই, পিঠে, ক্ষীর। বাবাও আর সেই মানুষটা নেই। মানুষ সারাজীবন একই থাকে না। যেমন বদলে যায় সময়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদল ঘটে আমাদের মনন, চিন্তাভাবনার। সরস্বতী পুজোয় সিজনার দিন শ্যামলী কাকিদের বাড়িতে পান্তা না খেয়ে এলে যেমন রাগ করে, তেমনি ইদের দিন আমার বাড়িতে বন্ধুবান্ধবরা না এলেও আমার মায়ের মনখারাপ হয়। তখন মনে হয় পুজো, ইদ কিংবা যে কোনও উৎসবের আসল মর্ম শুধু আচার-অনুষ্ঠানে নয়, বরং ভালোবাসা ও সৌহার্দ্যে, যা আমরা আমাদের পরিবার, বন্ধু এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভাগ করে নিই। ধর্ম আমাদের আলাদা করতে পারে, কিন্তু সেই উৎসবের আনন্দ আর ভালোবাসা আমাদের এক করে দেয়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.