যশোধরা রায়চৌধুরী: সে ছিল আমাদের বাঙালিদের এক পুজো। তিন দিনের জন্য সকালে বিকেলের ছটা জামা বা ফ্রক, জুতো, মোজা, চুলের ক্লিপ বা পকেটের রুমাল গুছিয়ে রাখা। আর যদি কাকু-মামু-পিসিদের দেওয়া জামা না থাকে তো বাবা-মায়ের দেওয়া একটা কী দুটো জামাকেই যক্ষের ধনের মতো আগলে এবেলা ওবেলা পরা। যেসব মায়েরা সেলাই কল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে জামা সেলাই করে দেন, তাঁদের শেষ মুহূর্তে বাজারে গিয়ে লেস আর অ্যাপ্লিকের ফুল কিনে আনা, জামায় সেসব লাগানো। আর শেষে বোতাম বসিয়ে হাতে সেলাই করে শেষ ফিনিশ দিয়ে, দাঁত দিয়ে সুতো কেটে মেয়ের দিকে এগিয়ে দেওয়া। নে দ্যাখ, পরে দ্যাখ।
আরেকটু বড় হলে, পুজো প্যান্ডেলেই রোম্যান্স, অমুকদা তমুকদার সঙ্গে অঞ্জলির ফুল আদানপ্রদানের মধ্যে দিয়েই কত না রোমাঞ্চ! অথবা সবাই মিলে প্যান্ডেলে ল্যাকপেকে কাঠের চেয়ারে বসে বসে আরতির ঢং ঢং শুনে, ঢাকের বাদ্যি শুনে, সন্ধে কাটিয়ে চোরা চাহনি। তখনও বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ডদের রমরমা নেই। সবই লুকনো প্রেম।
তাছাড়া সপরিবারে টাইম টেবিল দেখে, কু ঝিকঝিক ট্রেনে চেপে বেড়াতে যাওয়া পুজোর ছুটিতে। তার কত পরিকল্পনা। লুচি আর আলুরদম তিনথাকের টিফিন ক্যারিয়ারে গুছিয়ে নেওয়া। উলের জামা পরা জলের ক্যান্টিনে জল ভরা স্টেশনে নেমে, ট্রেন পাছে ছেড়ে দেয় সেই ভয়শুদ্ধু। নিজেদের আত্মীয়দের বাড়ি, না হলে দীপুদা। দীঘা-পুরী দার্জিলিং।
পুজো মানে প্যান্ডেলে সেজে ওঠা মা, মায়ের চারটি ছা, এমনকী সবুজ রঙের মহিষাসুর— সবার আবার একটি করে বাহন। প্রত্যেককে আলাদা করে লক্ষ করতে হয়, দেখতে হয়, মন দিয়ে। বাড়ি ফিরে আলোচনা করতে হয়। এত বড় দলবল বেঁধে মা আসেন, প্রায় এক মিছিল। কেউ ১৪৪ ধারা দেয় না, থুড়ি, ১৬৩ ধারা দেয় না!
আমরা বাঙালি। তাই, সহজ পাঠ প্রথম ভাগের দ্বিতীয় পাঠ পড়ার সময়েই জেনে গিয়েছিলাম, যে, ‘ফুল তুলে রাম বাড়ি চলে। তার বাড়ি আজ পূজা। পূজা হবে রাতে। তাই রাম ফুল আনে। তাই তার ঘরে খুব ঘটা। ঢাক বাজে, ঢোল বাজে। ঘরে ঘরে ধূপ ধূনা।’
তার অল্প পরে,
‘ রাতে হবে আলো। লাল বাতি। নীল বাতি। কত লোক খাবে। কত লোক গান গাবে। সাত দিন ছুটি। তিন ভাই মিলে খেলা হবে।’
সেই থেকে, আমাদের আশ্বিন আলাদাই। সেই থেকে বাঙালির জীবনে আশ্বিনের শারদপ্রাতে আলোকমঞ্জির বেজেই চলেছে।
যতক্ষণ ধরে সে আসে তার চেয়ে অনেক বেশি তাড়াতাড়িই সে ফুরিয়ে যায়। তিন দিনকে চুইং গামের মতো টেনে টেনে আমরা সাতদিন করি, দুহপ্তাও করতে পারি, তবু অনন্তের করে দিতে তো পারি না। তাই আসি আসি যতদিন, ভালো লাগা জড়ায়। যাওয়ার পর, সমবেত দীর্ঘশ্বাসের হাওয়া বয়। পুজো পুজো পুজো, হয়ে গেল পুজো।
ষষ্ঠীর সকালে যে ঢাকের বাদ্যি উৎসাহ উদ্দীপনায় ভরে দেয় আমাদের, নবমী নিশি পোহাতে শুরু করলেই সেই ঢাকের বাদ্যিই শূন্যতায় ঘিরে ফেলে। বিসর্জনের বাজনা, ক্রমাগতই আমাদের মনের ভেতরে দূরদূরান্ত অবধি খুলে দেয় এক ঊষর মরুভূমি, এক অনিবার্য খাঁ খাঁ ভাব। আমাদের বুকটাও হয়ে যায় ফাঁকা ঠাকুরদালানের মতো, একটিমাত্র প্রদীপ সম্বল… উড়তে থাকে খড় ও কাগজ, শোলার কুচি, রাংতার টুকরো।
শূন্যতার নতুন একটা মাত্রা, একটা তলহীন অন্তহীন ঘুরপাকের, পায়ের নিচে মাটি সরার এই বোধ। একটা করে পুজো চলে যায় আর আরও নিঃস্ব হই আমরা। আমাদের ছোটবেলাটাকে আরও একটু করে যেন হারিয়ে ফেলতে থাকি…। এবারে আরও বেশি করে হারিয়ে গেছে আমার পুজো। কাশফুলের সাদা গুচ্ছও যেন ধূসর ও কালচে।
এ বছরের পুজো(Durga Puja 2024) অন্য রকম। এ বছরের পুজো নিরানন্দ না হলেও, আনন্দে ফিরতে হচ্ছে রীতিমতো কসরত করে, অপরাধবোধের হাত এড়াতে হচ্ছে অনেক চেষ্টায়। মনে হচ্ছে কেবলই, ‘এই জীবন লইয়া আমি কী করিব’র মতো, এই অতি আনন্দ, অতি আলো, অতি ঢাকের বাদ্যি লইয়া আমি কী করিব? এ বছরের পুজো অভয়া বা তিলোত্তমার জন্য উই ওয়ান্ট জাস্টিস-এর আবহে এক অন্য রকম পুজো। কেননা উৎসব এখন আর উৎসব নেই। তা হয়ে গিয়েছে পথে নামা জনস্রোতের, প্রতিবাদের হাত বা মশাল তোলার উৎসব। বাংলার ছেলেমেয়ে গান বেঁধেছে অভয়ার জন্য, তিলোত্তমাকে নিয়ে নাটক লিখেছে। তারা জীবনে প্রথম পায়ে পা মিলিয়ে হেঁটেছে মিছিলে। কেননা তাদের কাছে অভয়া এক প্রতীক। সে যেন রক্তকরবীর নন্দিনী। অনেক বড় এক সিস্টেমের অন্যায়ের সামনে অভয়ার মৃত্যু যেন বলে দিয়ে যায়, সবকিছু ভালো নেই, সবকিছু ঠিক নেই। চারিদিকে যেসব শব্দবন্ধ উঠে আসছে তার অন্ধকার ঘন। থ্রেট কালচার থেকে দুর্নীতি, যা কিছু আলোড়িত করছে আমাদের তা যেন একটি বিন্দুতে গিয়ে মিলছে। অভয়ার রক্তঝরা শরীর, রক্তঝরা চোখ। প্রশ্ন তুলে দিয়ে যাচ্ছে আমাদের মনে। মেয়েদের নিরাপত্তা, কর্মক্ষেত্রে তার অবাধ চলাচল, রাত্রির ডিউটি করার সমস্ত ব্যাপারে অজস্র প্রশ্নচিহ্ন লাগিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।
অজস্র আলোর রোশনাইতে তাই পুজো এবার শুধু ভুলে থাকার উৎসব নয়। যুবসমাজের জেগে ওঠার ও জেগে থাকার উৎসবও। অতিরিক্ত খরচ করে নিজের জন্য জামা না কিনে অনেকে সামাজিক নানা কাজে ব্যাপৃত হতে চাইছে, চাইছে অনাথ বা বৃদ্ধ বা নির্বান্ধব মানুষকে কাপড় কিনে পাঠাতে। বা অন্যভাবে নিজেকে উপযুক্ত করে তুলতে, ব্যাপৃত করে তুলতে ভাল কাজে। বিবেক একেবারে মরে যায়নি বলেই, আজ নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। বড়লোকি বাবুপনা না করে, কিছুটা সচেতন কোন কাজে লেগে যাবার।
তারই ফাঁকে অসংখ্য মানুষ বন্যার্ত। এই বন্যাত্রাণও হয়ে উঠতে পারে এবার পুজোর ব্রত। নারায়ণ সেবা। বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর। পুজোর আগে আগে অনেকে সারা বাড়ির সমস্ত জিনিস নাড়িয়ে চাড়িয়ে, পরিষ্কার করতেন। চুনকাম করে পোকামাকড়, টিকটিকি নাশ করতেন। ফেলে দিতেন পুরনো পোকাকাটা জিনিস। কোনায় জমা ঝুল সাফ করতেন। ষষ্ঠীর আগে বাড়ি ঝকঝকে। উঠোন, বাগান, তকতকে। এবার অভয়া আমাদের ঝাঁকুনি দিয়ে গেছে। আমাদের মনের উঠোনে পুরনো সব মূর্খতায় টান পড়েছে, ফেলে দিতেই হবে।
আমরা সহজ পাঠের আরও একটা পাঠ বার বার পড়ছি এখন। “আজ মঙ্গলবার। পাড়ার জঙ্গল সাফ করবার দিন।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.