সোনালী ঘোষ: ‘তিলোদকম গঙ্গাজলং বা তস্মৈ স্বধা নমঃ।’ মহালয়া। তর্পণরত বাবার সামগ্ৰী নিয়ে ঘাটের একপাশে বসে ঢুলছি। সকালে ডাক দিয়েছেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র আর দশভুজা। ঘাটে মেলা বসেছে। তর্পণ সেরে বাবা ফিনফিনে ধুতি পড়ে সাইকেলে আমায় চাপিয়ে রাস্তায় কত গল্প বলেছে। ঘরদোর সব ঝাড়পোছ হচ্ছে আজ। নগেন কাকা আসবে পুরনো খবরের কাগজ, বাতিল জিনিস নিতে। এই টাকা মায়ের পুজোর হাতখরচ। নতুন কাপড়-জামাও কাল রাতে এসেছে ভানুকাকু আর সাবির চাচার দোকান থেকে। বাবা বলে এসেছিল। খানকয়েক ফুলিয়ার তাঁত, ধনেখালি একটা গরদের শাড়ি। আমাদের মানে কচিকাঁচার জন্য ফিতের মাপে ফ্রক আর দৈত্য সাইজের জুতো। ওর থেকে খালি পায়ে হাঁটা ভালো। এদিকে মা আলতা সিঁদুর রাখছে সব এঁয়োর শাড়ির সঙ্গে ওসব দিতে হয় যে। আজ আবার মা উনুনে নতুন মাটি দেবে, কালো হওয়া বাসন চকচকে করবে।
দেখতে দেখতে বোধন। পাশের বাড়ির দাদু লাঠি নিয়ে গলায় মাফলার জড়িয়ে আমাদের হাত ধরে মণ্ডপে। কত গল্প, দুর্গার কাহিনি। হাঁ করে গিলতাম। এদিকে শিউলি ভেজা ভোর, টুপটাপ কুয়াশার শব্দ আর দূরে চায়ের দোকানে পুরনো রেডিও থেকে ভেসে আসা আগমনী গান। বাড়ি ফিরলে লুচি-ঘুগনি। ঠাকুমা দু- একটাকা লুকিয়ে হাতে দিত। দাদারা ক্যাপ-বন্দুক কিনত। আমাদের ওসব বালাই নেই। পাড়ার মোড়ে উঠতি দোকানের ফুচকা আলুকাবলি ঘুগনি খেতে পয়সা খরচ হত। দূরের ঠাকুর দেখা বলতে বাবা সময় করে সাইকেলে বসিয়ে নিয়ে যাবে। কত ঠাকুর, রাস্তায় সার দেওয়া টিউব লাইট পোঁতা। যদিও সে আলো দেখার সুযোগ হত না কারণ দিনেমানে ঠাকুর দেখা। তবে ঢাকের বাদ্যি, তাও মাইকে না।
ভিড় তেমন নেই। কচিকাঁচারা প্যান্ডেল কাঁপাচ্ছে ক্যাপ ফাটিয়ে। ফেরার পথে বেলুন আর নিমকি-সিঙাড়া। সন্ধেবেলায় সেজেগুজে মা-কাকিমারা প্যান্ডেলে বসে বাড়ির সুখ-দুঃখের গল্প জমাত। পুজোয় কে কী কিনেছে, কাকে কী দিয়েছে, এছাড়া বাড়ির খুঁটিনাটি কথা। রাত বাড়ে, কুয়াশা পড়ে। বাড়ি ফিরে আমরা সেদ্ধ আলুর খোসা ছাড়াতে বসে যেতাম। মা পোলাও রাঁধতে ব্যস্ত, এবার আলুর দম চড়বে। এমন সব ভাইরাসে স্মৃতির মেমারি কার্ড ফুল।
এবং ফোন আসে “ম্যাম জোম্যাটোর একটা পারসেল আছে।’ আজ অষ্টমী। প্যান্ডেলের রিভিউ মোবাইল অ্যাপে। এখন কুয়াশার বালাই নেই। জামাকাপড় দেওয়ার বালাই নেই। যে যার মতো ফোন-পে-তে দিয়েছে জামা-কাপড় কেনার টাকা। অ্যামাজন, ফ্লিপকার্টের অফার বুক করলেই ঝামেলা শেষ। পুজোর চারদিন ভরসা অর্ডারের খাবার। রাতে ঠাকুর দেখা। গাড়ির চাকা অলিগলি ঘুরে পার্কিংয়ে নামাবে। তারপর হেঁটে ঠাকুর দেখে ফিরতি পথে সামান্য স্ন্যাক্স, সঙ্গে ফটো আপলোডে। মফসসল উঠে এসেছে শহরে। ওরাও পিছিয়ে নেই থিমের মেলায়। রিল ভিডিও সমানে চলছে। কোটি টাকার বাজেটের পুজো। তাতে রাজনীতির গন্ধ। কে বলবে দেশে অর্থনীতি বেসামাল। চলছে বিহারি বা পাঞ্জাবী গান.। আমাদের ছোটবেলায় পুজোর গান মানে কিশোর-রফি-শানু-আশা ।
আজ ভেতর-জ্বরে পুড়তে থাকে সব ভার্চুয়াল বন্ধু আর শো-অফ। আসলে সবাই একা। দশমীতে নেই কচুশাক, পান্তাভাত। কারণ সামনে কার্নিভ্যাল। রাজপথের র্যাম্পে হাঁটবে দুর্গা। তারপর পুরস্কার নিয়ে বাড়ি। নীলকন্ঠ পাখি নেই, নৌকা নিয়ে বিসর্জন নেই, বিদায়ে চোখে জল নেই। আছে কেবল পরের বছরে টেক্কা দেওয়ার রোখ। এত আলো তবু ভেতরে এক নিঃসঙ্গতার কূপ!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.