সৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়: আমাদের এই রোজকার জীবনে কত কিছুই না হারিয়ে ফেলি আমরা। গত পরশুই তো বুকপকেট থেকে হারিয়ে গেল একটা পেন। কখনও হাতঘড়ি, মানিব্যাগ, রুমাল। কেউ কেউ হারিয়ে ফেলে প্রিয় বন্ধু, প্রিয় মানুষ, কারও আবার মাথার ছাদ খোয়া গেছে তো কারও চাকরি। কিন্তু যা আমাদের সকলেরই এক না একদিন নিশ্চিত হারিয়ে যায়, তা হল শৈশববেলা। আর কে না জানে যেমনই হোক সেই শৈশবের দিন, হাজার দীনতাকে দূরে ঠেলে তা বড়ই রঙিন।
যদিও আমার জীবনের থেকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছে আস্ত একটা শৈশবের পুজো। পুজো আসছে একথা ভাবলেই চোখের সামনে আজও ভেসে ওঠে আমার বাপ, ঠাকুরদার গ্রাম। আমাদের পৈতৃক ঠাকুর দালানের চুনকামের গন্ধ, ঠাকুরদালানের পেল্লায় দরজা, আলকাতরার করা রঙ, এদিক ওদি্ক ছোটাছুটি করতে গিয়ে নতুন জামা কাপড়ে কতবার যে দরজার কালো দাগ লেগেছে তার ইয়ত্তা নেই, তার জন্য মায়ের কাছে বকুনি খেয়েছি ঢের। আসলে সেই সময় জামাকাপড় কেনা হত ওই পুজোতেই, একবার। সারা বছর কোনও কেনাকাটা নেই, নামী-দামি বিদেশি ব্র্যান্ডের জৌলুস নেই, তবুও অমোঘ মায়া ছিল সেই সব জামাকাপড়ে, সে যেন মা, বাবার স্নেহের সুতোয় বোনা।
পালমশাই ঠাকুর গড়তেন। আমি চৌকাঠে ঠায় বসে দেখতাম। কীভাবে খড় বাঁধাইয়ের পর মাটির প্রলেপে মৃন্ময়ীর আবির্ভাব হয়। নারকোলের মালায় রঙ গোলা হত, তাঁর হাতের শিল্প নিপুণতা ছিল ভীষণ। দেবী মূর্তির মুখের আদল থেকে দেহের গড়ন একটুও নড়চড় হত না। ফি-বছর অপরিবর্তনীয় রুপে বসনে, ভূষণে অলঙ্কারে সুসজ্জিতা দেবী স্বপরিবারে বিরাজ করতেন বেদিতে।
পুজোর চারটে দিন ঢাকের শব্দতে আমাদের ঘুম ভাঙত। সেই সময় মহালয়ার পরে ষষ্টীর দিন সকালে আবারও মহিষাসুরমর্দিনীর একটা টেলিকাস্ট হত। তখন টেলিভিশন বলতে কেবলমাত্র দূরদর্শন আর রেডিও বলতে ছিল আকাশবাণীর সম্প্রচার। বাড়ির সদর দরজার পাশেই ছিল একটা শিউলি ফুলের গাছ, ভোর বেলায় ম-ম করত চারদিক। সপ্তমীর ভোরে দোলায় করে নবপত্রিকা স্নানে যেতেন দেবী। রাশি রাশি কাশফুলের সারি আর সবুজ ধানে ঢাকা মাঠ। তার আলপথে চলেছেন দেবী। সে ছিল মঙ্গলময়ীর অনন্য যাত্রা। বিজয়ার দিন, ঠাকুর ভাসানের আগে বাগদিদের লাঠি খেলা চলত। দেবী জলে পড়লে একশো আটবার লিখতাম ওঁ হ্রীং শ্রী শ্রী দুর্গা মাতা সহায়।
ভাসানের পর ঠাকুরদালানের বেদিতে একটা ‘গাছা প্রদীপ’ জ্বলত। সেই শুন্যতার মুহূর্তে যা অনুভব করেছি প্রতিবার তার চেয়ে গভীর যন্ত্রণার কি কিছু থাকতে আছে? সেসব দিন হারিয়ে গিয়েছে। শহুরে আবাসনের পুজোয় কিছুই অনুভব হয় না আর। মনে আছে? সেই সদর দরজার পাশে শিউলি ফুলের গাছটা? সেই গাছটা এখন আর নেই, ঠিক যেভাবে নেই আমাদের পুরনো বাড়িটা। তবুও পুজো আসে? ঠাকুরদালানটা এখনও আছে। তবে পালমশাই নেই।তাই ট্রাকে ঠাকুর আসে, দেবীর মুখ বদলে যায় বছর বছর। ক্লাবের ছেলেরা মিলে আজকাল কমিটি করে সেই পুজো চালায়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.