পূর্বা কুমার: প্রম্পটার চাপা গলায় হিসহিস করে বলে চলেছে, ”রাবণের প্রবেশ! রাবণের প্রবেশ!” রাবণ তখন গ্রিন রুমের পিছনে বিড়ি খাচ্ছিল। বিড়ি ফেলে হাওয়াই চটি পায়ে দিয়েই ধড়মড় করে স্টেজে উঠেই গলা কাঁপিয়ে গদগদ স্বরে বলে ওঠে, ”রাবণের প্রবে-এ-এ-শ।” তার পরই আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে রাবণের অট্টহাসি, ”হু হু হু হু হা হা হা হা! ওরে ভিখারি! পাঠায়েছি, পাঠায়েছি আমি মহী রাবণকে! রাম লক্ষ্মণকে বেঁ-এ-এ-ধে নিয়ে আসবে এই স্বর্ণলঙ্কায়… হু হু হু হু হা হা হা হা।”
স্টেজের একপাশে রানি মন্দোদরী অনেকক্ষণ থেকেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মন্দোদরীর চোখে ছানি কাটানো চশমা। চশমা তুলে বার বার আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে অসুবিধা হচ্ছে। এ ঘটনা ‘সীতার কান্না’ যাত্রাপালার। মন্দোদরীর পার্ট করছে পচাদাদু। মাস দুই হল চোখ কাটিয়েছে। তখন অ্যামেচার যাত্রা। বাজেট কম। ফিমেল ভাড়া করতে পারা যেত না। নায়িকার রোল পচাদাদুই করত। ছোটখাট গোলগাল চেহারায় বেশ মানাত।
পুজোর (Durga Puja) অষ্টমী আর নবমীর দিন আমাদের গ্রামে যাত্রার আসর বসত। একদিন পৌরাণিক, একদিন সামাজিক। সারা বছর ধরে চণ্ডীমণ্ডপে রিহার্সাল চলত। সন্ধে সাতটা বাজলেই রিহার্সালের ঘণ্টা পড়ত। আমরাও পড়াশোনার পাততাড়ি গুটিয়ে ছুট। সারা বছর রিহার্সাল শুনে শুনে সমস্ত ডায়লগ মুখস্ত হয়ে যেত। মহালয়ার পর পুজো যেন আসতেই চাইত না। সেই সপ্তাহের এক এক দিনকে যেন এক এক মাস মনে হত।
ছোট্ট গ্রাম। ক’ঘর মাত্র লোক কিন্তু এইসময় প্রত্যেক বাড়ি আত্মীয় কুটুমে ঠাসা হয়ে যেত। তার পর যাত্রার দিন চট পাতা নিয়ে সে কী হানটান! যাত্রা শুরু হত রাত এগারোটায়। কিন্তু সকাল নটা থেকে আমাদের বন্ধুদের মধ্যে জায়গা দখলের প্রতিযোগিতা শুরু হত। কে কত স্টেজের কাছাকাছি বসতে পারে। আমি হয়তো একেবারে স্টেজের সামনে চট পেতে এলাম, একঘণ্টা পর গিয়ে দেখলাম কেউ সেটা তুলে পাশের কচুবনে ফেলে দিয়ে নিজেরটা পেতেছে। শুরু হত তুমুল ঝগড়া।
তখন ফাইভ-সিক্সে পড়ি। সকাল থেকে এত দৌড়ঝাঁপ করে যাত্রা শুরু হতেই ঢুলতে শুরু করতাম। যখন যুদ্ধ হত কিম্বা জোরসে বাজনা বেজে উঠত তখন আবার একটু জাগতাম। তার পর আবার ঢুলুনি। এই রকম ঘুমিয়ে জেগে,জেগে ঘুমিয়ে রাত কাবার হয়ে যেত। শিব, দুর্গা ইত্যাদি দেবতার সাজে কেউ স্টেজে উঠলেই মা ঠাকুমারা জোড়হাত করে প্রণাম করত। ওদের দেখাদেখি আমরাও প্রণাম করতাম। যাত্রা শেষ হতে ভোর হয়ে যেত।
আজকে এই কেরিয়ার সচেতনতার যুগে, ‘ছোট পরিবার সুখী পরিবার’-এর জমানায়, সোশাল মিডিয়ার দুনিয়ায় আমরা নিজেদের অজান্তেই কখন যেন একাকীত্বের কৃষ্ণগহ্বরে ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছি। যখন দেখি পুজোর আনন্দ মানে কেবল প্যান্ডেল হপিং আর ভূরিভোজ, তখন আমাদের সেই হারিয়ে যাওয়া নিখাদ আনন্দের দিনগুলোর জন্য বড্ড বেশি মন করে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.