অসীম হালদার: শৈশবে পুজোর দিনগুলো কেটেছে টালির চালের ভাড়াবাড়িতে। সে বাড়ির চাল দিয়ে বর্ষায় জল পড়লেও পুজোর মজা ছিল অন্যরকম। বাড়িওয়ালার বড় ছেলে বাপ্পাদা পুজোর আগে সাউন্ড বক্স, রেকর্ড প্লেয়ার বাজিয়ে টেস্ট করত। কদিন বাদে মণ্ডপে বাজবে। দুপুরে শুয়ে শিল্পীদের গান শুনে ঘুমিয়ে পড়তাম । স্মৃতিতে ভেসে ওঠে স্বর্ণযুগের গান শোনার দিনগুলি। তখন সবার বাড়িতে রেডিও। তার সঙ্গে পুজোর একটা মাখামাখি সম্পর্ক ছিল। বাবা আগের দিন রেডিওর নব ঘুরিয়ে ঠিক করে রাখত, ভোর চারটেতে মহালয়া শুরু হবে। অত ভোরে লেপের মধ্যে থেকে ওঠা যায়! মহালয়া শুনেই চোখ বুজে আসত।
পুজোতে একসেট জামাপ্যান্টই পেতাম। তার গন্ধই ছিল আলাদা। জুতো কিনতাম এক সাইজ বড়। সেটা দিয়েই দুবছর কাটাতাম। বড়মামা একবার একটা কমলা রংয়ের প্যান্ট কিনে দিয়েছিল। খুব পছন্দ হয়েছিল সেটা। বাইরে থেকে প্রাপ্তি এটুকুই। নববর্ষ বা কোনও বাড়ির অনুষ্ঠানে একটাই সেট। রেডিমেড জামা পেতাম আর বাবা দর্জির কাছ থেকে প্যান্ট বানিয়ে দিত। দর্জিকে বলত, একটু বেশি করে কাপড় রাখতে। যাতে দুবছর টেনেটুনে পরা যায়। তখন ছিল হাফপ্যান্টের যুগ। ক্যাপ ফাটাতে দারুণ মজা পেতাম।
ভাড়াবাড়ির স্থান বদলেছে। আমি তখন ক্লাস এইটে। বন্ধুদের দেখে একটা ফুলপ্যান্টের শখ হয়েছিল। কিন্তু সংসারে ‘টানাটানির’ জন্য বলার সাহস হত না। তবু একদিন মাকে বলতে বাবা দর্জিকে দিয়ে ফুলপ্যান্ট বানিয়ে দিয়েছিল। একটা ‘ব্যাগিস’ স্টাইলের জামার শখ ছিল। সে আশাও মিটল। বন্ধুদের মতো অত ভাল না হলেও মনের মত পোশাক পেয়ে পুজোটা জমিয়ে উপভোগ করেছিলাম। এই স্বস্তি দীর্ঘস্থায়ী হল না। আমাদের বাড়ি তৈরির খরচের জন্য অনেক শখই পূরণ হত না।
পরের বছর মাধ্যমিকে বসব। মন তখন পড়াশোনায়, জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা বলে কথা। তাই ঠাকুর দেখতে একদিনই বেরোব ঠিক করলাম। সম্ভবত সেদিন ছিল সপ্তমী। রাস্তার দুপাশে আলোর ঝলকানি আর মাইকে গান বাজছে। সে বছর নতুন জামাপ্যান্ট হয়নি। ভাবলাম ঘরে যা আছে তাই পরেই একটু ঘুরে আসব। দুবছর আগের বানানো প্যান্ট পরতে গিয়ে দেখি কোমর পর্যন্ত কিছুতেই উঠছে না। টেনেটুনে পরা গেলেও হাঁটতে বেশ অসুবিধে হচ্ছে। যাকগে, সেটা পরেই কোনও মতে খানিক ঘুরে এলাম।
এখনকার মতো এত প্যাণ্ডেল, ঠাকুর নিয়ে প্রতিযোগিতা, প্রাইজ, স্পন্সরদের ভিড় দেখিনি। শপিং মল আর অনলাইনে কেনাকাটা এখন সারাবছর ধরে। পুজোর জামাপ্যান্টে আগের সেই গন্ধটা খোঁজার চেষ্টা করি কিন্তু পাই না। রেডিওকে টেক্কা দিয়ে এগিয়ে হাইফাই নেটওয়ার্ক। রেকর্ড প্লেয়ারে বাজতে থাকা পুরনো দিনের গান আর ভোর চারটেতে উঠে রেডিওয় মহালয়া শোনার দিনগুলো হারিয়ে গিয়েছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.