মানস শেঠ: কাঁচের বয়াম ভাঙার সঙ্গে পিঠে কিল পড়ার এক দুষ্টু-মিষ্টি প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় পিঠে পিঠে বুঝেছিলাম আমি! দশমীর দিন। সকালবেলা। ঠাকুর ভাসানের ঢের দেরি। লোভে পাপ আর পাপে কিল এটা মাথার মধ্যে না ঢুকলেও বয়াম ভেঙে ফেলার পর সেটা বুঝে গেছিলাম। আর যদি সেই বয়াম হয় নারকেল নাড়ুর, তাহলে আর কথাই নেই!
পঞ্চমীর দিন বাড়িতে আসত নারকোল। দশমীর প্রণাম করার পর ছোট্ট ডিসে দুটো করে নারকেল নাড়ু যেন ছিল অধিকার। পাশে সঙ্গত করত কুচো গজা আর নিমকি। নাড়ুর যে একলা চলার অধিকার নেই! মা অনেক কষ্ট করে নারকেল নাড়ু বানিয়েছিল দশমীর জন্য, সেটা যদি চুরির দায়ে বয়াম ভেঙে যায়, রাগ কার না ধরে!
দুর্গাপুজোয় যতটা না আনন্দ হত, তার চেয়ে বেশি আনন্দ হত ঠাকুর ভাসান গেলে। বড়দের প্রণাম করা মানেই আমাদের নারকেল নাড়ুর উপর অধিকার জন্মাত। চিনি হোক বা গুড়-যে রং-ই হোক না কেন, জিভের সঙ্গে তার অলিখিত পিরিত। কলাপাতায় দুর্গা নাম একশো আট বার লিখতে হয়নি আমাকে, বাবার কাজ ছিল সেটা। বাবাই ডেকে আনত ঘরের মঙ্গল।
বাড়ির বড়দের প্রণাম সেরে, একাদশীর দিন বন্ধুরা পাড়া বেড়াতে যেতাম। বিকেলের গলি ক্রিকেট খেলায় যে দিদা রেগে যেত, পাড়ার পেয়ারা গাছে উঠে পড়ায় যে কাকু বাবাকে বলে দেবে হুমকি দিত, যে দিদি অতি সহজে জ্যামিতি বুঝিয়ে দিত সেদিন সব্বার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে হবে। কারণ ওই নাড়ু লাভ। মোবাইল ফোনের তিড়িং বিড়িং অত্যাচারে তখনও নারকেল গাছ নিজেদের আত্মোৎসর্গ করে দেয়নি। বাজারে তাই নারকেল আগুনসম হয়নি, তাই অতি সহজে নারকেল নাড়ু স্থান পেত দশমীর পাতে।
দুর্গাপুজো এলেই আমার মনে এসে যায় সেই নাড়ু আর নিমকির ছবি। পাড়ার ভাই থেকে যখন দাদা হয়ে উঠছিলাম, দুগ্গা ঠাকুরের সঙ্গে লরি করে যাবার বদলে যখন পায়ে হেঁটে বিসর্জনে যেতাম, তখনও এসে মনটা নাড়ু নাড়ু করত। এরপরের ইতিহাস যেন ধীরে ধীরে বদলে গেল। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঠাকুর ভাসানের ইতি না ঘটলেও, পায়ে হাত দিয়ে বিজয়া দশমীর প্রণাম এখন মেসেঞ্জার বা হোয়াটসআপের মেসেজে। ইমোজিতে ভরে ওঠে ইনবক্স। বিজ্ঞান দাগিয়ে দিয়েছে মোবাইলের ব্যবহারে নারকোল গাছের ক্ষতি, তাই নারকেল মহার্ঘ্য। মহার্ঘ্যর বাধা কাটিয়ে উঠলেও পরিশ্রম এবং নিষ্ঠার কাছে হেরে যায় স্মৃতির হেঁসেল।
হেঁসেলে আর নাড়ু তৈরি হয় না, হলেও সময়ের পাকচক্রে তার পাক হয়ে যায় পলকা। মিষ্টির দোকানগুলো মিহিদানা, গজার সঙ্গে বিক্রি করতে শুরু করেছে নারকেল নাড়ু। রান্নাঘরের পরিশ্রম থেকে মুক্তি। অল্প দামে আমরা কিনতে ছুটছি সেই স্মৃতি, কোনও এক বিকেলে অলসযাপনে তারাই ছায়া ঘনিয়ে আসে মনে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.