প্রতীকী ছবি
এতদিনে সিপ অর্থাৎ সিস্টেম্যাটিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যানের গুরুত্ব এবং উপযোগিতার কথা জানেননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। কিন্তু সিপ তো দৈনিক, মাসিক, সাপ্তাহিক–নানাভাবে করা যেতে পারে। কোন ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ স্তরের উপকারিতা পেতে পারবেন গ্রাহক? বিস্তারিত জানালেন বিনিয়োগ পরামর্শদাতা প্রেমাংশু দাস।
দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন আর্থিক লক্ষ্যে পৌঁছাতে গেলে তার জন্যও আমাদের অনেক আগে থেকে প্ল্যান করতে হয়। বীজ বপন করতে হয়। সেটা দশ মাস আগেও হতে পারে, পাঁচ বছর হতে পারে, আবার ২৫-৩০ বছরের হতে পারে। নির্বোধ সঞ্চয়কারীদের কথা ছেড়ে দিন! যাঁরা সঞ্চয় থেকে বিনিয়োগের দিকে যাত্রা করেছেন, তাঁরা এতদিনে জেনে গিয়েছেন মিউচুয়াল ফান্ডের সিপ (SIP বা Systematic Investment Plan) সম্বন্ধে। নাহলে শুধুমাত্র মে-২০২৪ এই ইন্ডাস্ট্রিতে SIP র মাধ্যমে আসা অর্থের পরিমাণ ২০,৯০৪ কোটি হত না। ৩১ মে-তে ইন্ডাস্ট্রির নিট লগ্নির পরিমাণও ৫৮.৯০ লক্ষ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছত না। অনেককে বলতে শুনি যে, তার মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ নেই বটে কিন্তু সিপ করা আছে।
কিন্তু কেন সিপ? কী এই সিপ? না, সিপ কোনও পণ্য নয়, বিনিয়োগের একটি পদ্ধতি মাত্র। ব্যাঙ্ক বা পোস্ট অফিসে আপনি যে রেকারিং ডিপোজিট করেন মিউচুয়াল ফান্ডে, তারই নাম সিপ। সিপ-এর মাধ্যমে বিনিয়োগ করলে সুবিধার পাল্লাটা বেশ ভারী। ছোট্ট ছোট্ট বিনিয়োগের মাধ্যমে একটা বড় তহবিল গঠন করা যায়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটা গড়পড়তা দামে ইউনিট কেনা যায় (rupee cost averaging), ডিসিপ্লিনড থাকা যায়, বাজারের ওঠা-পড়া (volatility) যাই হোক না কেন বিনিয়োগ চলতেই থাকে। বাজারের ট্রেন্ড যদি ঊর্ধ্বমুখী হয় তবে ভ্যালুয়েশনে তা প্রতিফলিত হয়, উল্টোদিকে বাজারের ট্রেন্ড যদি নিম্নমুখী হয় তবে ভ্যালুয়েশনে নেগেটিভ দেখালেও পরোক্ষভাবে কম দামে অনেক বেশি ইউনিট একত্রিত করা যায়। আর বাজার বাড়লেই টোটাল ভ্যালুয়েশনটা খুব দ্রুত বেড়ে যায়। করোনাকালে সকলেই এর স্বাক্ষী।
আর সিপ শব্দটি শুনলেই অবধারিতভাবে আমাদের মনের মধ্যে গেঁথে যায় মান্থলি সিপ-এর ধারণা, অর্থাৎ মাসের কোনও একটি তারিখে আমার ব্যাঙ্ক থেকে টাকা কাটবে কোনও একটা নির্দিষ্ট স্কিমে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে, যেখানে তারিখ, টাকার পরিমাণ, স্কীম সব আগে থেকেই নির্দিষ্ট করা থাকে। একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই। আমরা অধিকাংশই তো এখন দৌড়চ্ছি আমাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ তৈরির উদ্দেশ্য নিয়ে। টি-২০ ওয়ার্ল্ড কাপ ক্রিকেট চলছে আর ক্রিকেটের প্রতি ক্রেজ আমাদের একটু বেশিই। বলতে পারেন এক চোখো। সন্তানকে ক্রিকেটার বানানোর স্বপ্ন নিয়ে অভিভাবক হিসাবে আপনি যদি এই চারটি বিকল্প হাতে পান, আপনি কোনটা বেছে নেবেন?
(ক) মাসে একদিন ফুল ডে কোচিং
(খ) মাসে দুদিন ৮ ঘন্টার কোচিং
(গ) সাপ্তাহিক ৫ ঘন্টার কোচিং
(ঘ) একদিন অন্তর ২ ঘন্টার কোচিং। সব ক্ষেত্রেই মাসিক খরচ সমান।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাবে যে, সকলে বিকল্পটি বেছে নেবেন, কারণ সব কিছুর বিচারে এটিই সেরা। তাহলে সিপের বেলায় মান্থলি বা মাসিক কেন? কেন উইকলি বা সাপ্তাহিক নয়? কেন ডেইলি বা দৈনন্দিন নয়? বাজার প্রতিদিন খোলা থাকে না বলে প্রতিদিন মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিটের কেনাবেচা হয় না। শনি ও রবিবার বাদ দিয়ে সপ্তাহের অন্যান্য দিনগুলিতে খোলা আছে ধরে নিলে একটি মাসের মধ্যে সর্বাধিক ২০-২২ দিন পাওয়া যায়, যেদিন বাজার খোলা থাকে (business day)। সোম থেকে শুক্রের মধ্যেও যদি আবার কোনও কারণে বাজার বন্ধ থাকে তাহলে মাসের এই সর্বাধিক দিনের সংখ্যা কমতে থাকে। বছরে মোটামুটি ২৫০ দিন পাওয়া যায়। বাজারের ওঠানামার সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিটি বিজনেস ডে-তে মিউচুয়াল ফান্ডের ন্যাভ-এর তারতম্য ঘটে।
গড়পড়তা দামে ইউনিট কেনাই যেখানে সিপ-এর মুখ্য উদ্দেশ্য, সেখানে মাসের কোনও একটি নির্দিষ্ট দিনের বদলে যদি আমি সপ্তাহের একটা নির্দিষ্ট দিনে বা মাসের সব কটি দিনেই কিনতে পারি, তাহলে কিন্তু আরও বেশি সুবিধা পাওয়া যায়। বাজার কোন দিন চড়া, কোন দিন সস্তা–তা তো আগে থেকে বলে কয়ে হয় না। তাই কেনার কিস্তি (frequency) যত বাড়বে তত আপনার গড়পড়তা দামের সুবিধা হবে। বাজারের ওঠা নামা যত বেশি, স্কিমের ভোলাটিলিটি যত বেশি (লার্জ ক্যাপের তুলনায় মিড ক্যাপ, ও মিড ক্যাপের তুলনায় স্মল ক্যাপে ভোলাটিলিটি বেশি), গড়পড়তা দামের সুবিধা তত বেশি।
আসলে আমরা কাজের পারিশ্রমিক অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাসের শেষে একবারই পাই। লোনের ইএমআই, ইলেকট্রিক বিল, কেবলের বিল, স্কুল কলেজের বেতন, এমনকি বাড়ির কাজের লোকের বেতন আমরা মাসের শেষে একবারই দিয়ে থাকি। আর তাই অবচেতনভাবেই সিপ ইনস্টলমেন্ট-এর ক্ষেত্রেও মান্থলি অপশন আমাদের মাথায় প্রথমেই এসে যায়। কোনও ফান্ডে মাসিক ৫০,০০০ টাকা সিপ করার থেকে যদি ২,৫০০ টাকা প্রতিদিন সিপ করেন, তাহলে রুপি কস্ট অ্যাভারেজিং-এর সুযোগ অনেক বেশি।
আসুন, সঙ্গে থাকা ছবির মাধ্যমে দেখি সত্যিই এটা হয় কি? ০৫/০৯/২০১০ তারিখে লঞ্চ হওয়া Nippon India Small Cap Fund শেষ ১১ বছরে মান্থলি ও ডেইলি সিপ কীভাবে পারফর্ম করেছে। ১,৪৬৩ টাকা প্রতিদিন সিপ বনাম ৩০,০০০ টাকা মাসিক সিপ। মার্কেট ভ্যালু ও রুপি কস্ট অ্যাভারেজিং-এ মান্থলি সিপ এগিয়ে থাকলেও গ্রোথের ক্ষেত্রে সামান্য পিছিয়ে। ডেইলি সিপ-এর কিছু অসুবিধা দেখে নিই। মান্থলির তুলনায় চক্রবৃদ্ধির সুবিধা (compounding benefit) সামান্য হলেও কম। ব্যাঙ্ক পাসবুক ও মিউচুয়াল ফান্ডের অ্যাকাউন্ট স্টেটমেন্টে ট্র্যানজ্যাকশনের সংখ্যা বেশি, নজর রাখতে হবে। রেকর্ড রাখা ও ক্যাপিটাল গেন ট্যাক্স ক্যালকুলেশন একটু জটিল। লার্জ ক্যাপে ভোলাটিলিটি কম থাকার জন্য খুব একটা কার্যকর নয়। ফান্ড ম্যানেজারের দক্ষতা ও স্ট্র্যাটেজির ওপরেও ডেইলি সিপ নির্ভর করে, তাই সঠিক ফান্ড নির্বাচন করতে হবে। বাজার খোলার দিনের কমা বাড়ার জন্য সব মাসেই মোট বিনিয়োগের হেরফের হবে।
ডেইলি সিপ ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের ও যাঁরা দিন শেষে মজুরি পান, তাঁদের জন্য আদর্শ। ডেইলি সিপ সেভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন না করলেও আগামী দিনে এর জনপ্রিয়তা বাড়বে বলে মনে হয়। শুধুমাত্র আজকের লেখা দেখে অনুপ্রাণিত হবেন না। আমি সম্যক ধারণা দেবার চেষ্টা করছি মাত্র। বোঝার চেষ্টা করুন। মান্থলি না ডেইলি সিপ? এই দ্বন্দ্ব ছিল, আছে, থাকবে। অধিকাংশ বিনিয়োগকারীর কাছে মান্থলি সিপ-ই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। মাসিক বা প্রতিদিন যাই হোক না কেন, আপনার আর্থিক লক্ষ্যে অবিচল থেকে সময়ের সাথে চক্রবৃদ্ধির সুবিধা নেওয়াই হোক প্রধান লক্ষ্য। অবশ্যই আপনার পরামর্শদাতার সঙ্গে যোগাযোগ করে সিদ্ধান্ত নেবেন। আমার মাধ্যমে যাঁরা বিনিয়োগ করেন, কিস্তির পরিমাণ বড় হলে আমি সাধারণত এই নীতি প্রয়োগ করি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.