অরূপ কর: ২০২৪-এর লোকসভা ভোট (Lok Sabha Election) দুয়ারে কড়া নাড়ছে। গত বৃহস্পতিবার দিল্লিতে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমনের পেশ করা মোদী সরকারের অন্তর্বর্তী বাজেটে তেমন বড় কোনও চটকদার ঘোষণা পাওয়া যায়নি, যাকে খোদ প্রধানমন্ত্রী ‘রেওড়ি’ বলে কটাক্ষ করে থাকেন। যথারীতি বিরোধীরা নির্মলার বাজেটের সমালোচনায় সরব। খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই (Mamata Banerjee) ধরনামঞ্চে কটাক্ষ করে বলেছেন, ”এটা অন্তর্বর্তী নয়, মোদি সরকারের ‘অন্তিম’ বাজেট!” এটা বিস্ময়ের নয়, রাজনীতির চেনা অঙ্কেই তাঁর কুশীলবরা কথা বলতে অভ্যস্ত। কেন্দ্রের বিরুদ্ধে লাগাতার আর্থিক বঞ্চনার ইস্যুতে সরব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বঞ্চনার কাঁটা পেরিয়ে রাজ্যে উন্নয়নের ধারা বজায় রেখেছেন বলে দাবি করে থাকেন তিনি। অন্যদিকে বিরোধী শিবির আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে তাঁকে নিশানা করে। এই প্রেক্ষাপটে রাজ্য সরকারের বাজেট (West Bengal Budget 2024) পেশ হতে চলেছে ৮ ফেব্রুয়ারি।
রাজ্যে পালাবদলের মাধ্যমে ২০১১-এর ২১ মার্চে শেষ হওয়া অর্থবর্ষের হিসাবে অনুযায়ী, বিগত বাম সরকারের রেখে যাওয়া ১.৯০ লক্ষ কোটি টাকার ঋণের ভার মাথায় নিয়েই যাত্রা শুরু করতে হয় ঘাসফুলের সরকারকে। তার মধ্যেই গ্রামের মানুষকে সুরাহা দিতে, পাশাপাশি তাঁদের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ানোর উদ্দেশে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রীর মতো একগুচ্ছ সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প চালু হয়। গত কয়েক বছর ধরে প্রকল্পগুলি চলছে রাজ্যে, যাতে বিপুল সংখ্যক মানুষ উপকৃত হয়েছেন বলে সরকারের দাবি।
রাজ্য সরকারি কর্মীরা যখন কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের সমহারে ডিএ (DA) চেয়ে অবস্থান-ধরনায় বসেন, তখন রাজ্য সরকারের তরফে সওয়াল করা হয়, কেন্দ্র যে রাজ্যের প্রাপ্য দিনের পর দিচ্ছে না, তখন সরকারি কর্মীদের বুঝতে হবে, রাজ্য সরকারের ভাঁড়ারে পর্যাপ্ত অর্থ নেই বলেই সমহারে মহার্ঘ্য ভাতা দেওয়া সম্ভব নয়। তারপরও গত বছরের বাজেটে ৩ শতাংশ বাড়তি ডিএ ঘোষিত হয়। অবসরপ্রাপ্ত পেনশনভোগীরাও এই সুবিধা পান। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পের প্রাপক কোটি কোটি মহিলা। ৬০ বছর পেরলেই সরাসরি বার্ধক্যভাতার আওতায় পড়বেন তাঁরা। বিধায়ক উন্নয়ন তহবিল বিধায়কদের এলাকা উন্নয়ন প্রকল্প (বিইইউপি) কর্মসূচিতে এলাকা উন্নয়ন খাতে বাৎসরিক ৬০ লক্ষ টাকা থেকে ১০ লক্ষ থেকে বাড়িয়ে করা হয় ৭০ লক্ষ টাকা।
রাস্তাশ্রী প্রকল্পে বরাদ্দ হয় তিন হাজার কোটি টাকা। ১১ হাজার কিলোমিটার রাস্তা তৈরি, পুরনো রাস্তা সংস্কারের লক্ষ্য ধার্য হয়। ১৮-৪৫ বছর বয়সি ২ লক্ষ যুবক-যুবতীর আর্থিক সহায়তা বাবদ সর্বাধিক ৫ লক্ষ টাকার ঋণের ঘোষণা করা হয় ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ডে। দেউচা-পাঁচামিতে কর্মসংস্থানের ৩৫ হাজার কোটি টাকা লগ্নির ঘোষণা হয়। রাস্তা, বিধায়ক উন্নয়ন তহবিলে বরাদ্দ সচল রেখে পরিকাঠামো চাঙ্গা করার পরিকল্পনা গৃহীত হয়।
গত বছর যখন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বাজেট পেশ করেছিলেন, তখন ৫.৮৬ লক্ষ কোটি টাকা দেনার বোঝা ছিল রাজ্যের ঘাড়ে। সেসময় রাজ্য সরকারের সামনে এক্সাইজ বা শুল্ক বাবদ আয় ও রাজস্ব সংগ্রহে জোর দেওয়া ছাড়া রাস্তা ছিল না। রাজ্যের সামনে একটা উদ্বেগের চিত্র ছিল। ২০২২ এর মার্চে দেনার পরিমাণ ছিল ৫.২৮ লক্ষ কোটি টাকা। আর্থিক ঘাটতি ৫৩,৪৩১.৭৬ কোটি, রাজস্ব ঘাটতি ৩২,৯৬৩.৬০ কোটি টাকা। দেনার দায় বেড়ে চলে। সেই অবস্থায় রাজ্যের শুল্ক বাবদ সংগ্রহের টার্গেট ধরা হয় ১৬৫০০ কোটি টাকা। এই টার্গেট অর্জনের লক্ষ্যে এগতে রাজস্ব সংগ্রহে জোর উদ্যমে ঝাঁপ দেয় সরকার। আবগারি দপ্তরের পাশাপাশি জমি থেকে পাওয়া রাজস্ব আদায়েও জোর দেওয়া হয়।
রাজ্য সরকারের দাবি, ২০২৩-২৪ সালের বাজেট এস্টিমেট অনুযায়ী, ২০১০-১১ থেকে রাজ্যের নিজস্ব আয় চারগুণের বেশি বেড়েছে। ২২,১২৯ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৮৮,৫৯৬ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। উন্নয়ন খাতে ব্যয় ১৮ হাজার কোটির ঘর থেকে সাত গুণের বেশি বেড়ে তা ১ লক্ষ ৩৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছে। মূলধনী খাতে ব্যয় বেড়েছে ১৫ গুণের বেশি। এর মধ্যে পরিকাঠামো খাতে ব্যয় বেড়েছে ৬ গুণের বেশি। সামাজিক খাতে ১২ গুণ ব্যয় বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় অন্তর্বর্তী বাজেটে নির্মলা সীতারামন গরিব, মহিলা, যুবসমাজ ও কৃষক – এই চার অংশের উপর জোর দেওয়ার কথা বলেছেন বটে, কিন্তু একের পর এক দেশব্যাপী সমীক্ষায় যখন বেকারি, কর্মহীনতাকে প্রধান উদ্বেগের বিষয় হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে, তখন তিনি ৫৮ মিনিটের বাজেট ভাষণে একবারের জন্যও প্রসঙ্গটাই তোলেননি! ২০৪৭ নাগাদ বিকশিত ভারত গঠনের রাস্তায় কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্য কোনও স্কিম ঘোষণা তো দূরের কথা। গ্রামীণ কর্ম সংস্থান গ্যারান্টি স্কিম মনরেগায় বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র ২৬ হাজার কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ এ ছিল ৬০ হাজার কোটি, হয়েছে ৮৬ হাজার কোটি (বাজেট এস্টিমেট)। আয়ুষ্মান ভারত স্কিমে মাত্র ৩০০ কোটি টাকা বেড়ে ৭২০০ কোটি থেকে হয়েছে ৭৫০০ কোটি। প্রধানমন্ত্রী গ্রামীণ আবাস যোজনায় আগামী ৫ বছর আরও ২ কোটি অতিরিক্ত বাড়ি তৈরি, ১ কোটি বাড়ির ছাদে বিনা খরচে ৩০০ ইউনিট বিদ্যুৎ সরবরাহে রুফটফ সোলারাইজেশনের প্রতিশ্রুতি রয়েছে বটে, কিন্তু সামগ্রিক অভিমুখ জনবান্ধব নয় বলে মত নিন্দুকদের।
অন্যদিকে এক প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে এগোতে হচ্ছে রাজ্যকে। ১০০ দিনের কাজের টাকা মিলছে না কেন্দ্রের তরফে। ফলে ভুগতে হচ্ছে রাজ্যের খেটে খাওয়া মানুষকে। শুধু মমতা বন্দ্যেপাধ্যায় নন, বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের অনেকেই একে একে মুখ খুলছেন। কেন্দ্রীয় বঞ্চনার ইস্যুতে বামশাসিত কেরল সরকার দিল্লিতে প্রতিবাদের কর্মসূচি নিয়েছে। বাজেটে দক্ষিণ ভারত উপেক্ষিত দাবি করে পৃথক রাষ্ট্রের সওয়াল করে বিতর্কে জড়িয়েছেন কংগ্রেস সাংসদ! এমনকী রাজ্যে বিজেপি-বিরোধী আসন সমঝোতার ইস্যুতে প্রবল মতভেদ হওয়া সত্ত্বেও খোদ রাহুল গান্ধী পর্যন্ত মমতার কেন্দ্রীয় বঞ্চনার তত্ত্বকে সমর্থন করেছেন। সোশাল মিডিয়ায় তিনিও লিখেছেন, বাংলায় ৭৬ লক্ষ মানুষ ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পের উপর ভরসা করে থাকে। সেখানে এই খাতে অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ২ বছর ধরে কাজ করেও টাকা পাচ্ছে না মানুষ।
সামগ্রিকভাবে বিরোধীদের অভিযোগ, কেন্দ্রের শাসকরা রাজ্যে রাজ্যে ডবল ইঞ্জিন সরকার চায়। অর্থাৎ সব রাজ্যেও তারা সরকারে থাকবে। বিরোধী দলগুলি ক্ষমতায় থাকলে চলবে অসহযোগিতা। প্রাপ্য অর্থ দেওয়া হবে না নানা যুক্তি, ওজর দেখিয়ে।
বেশ কয়েক দশক আগে কংগ্রেসের যখন কেন্দ্রে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল, তখন এই বামেদেরই বলতে শোনা যেত, কেন্দ্র রাজ্যগুলির প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ করে। জমানা বদলে গিয়েছে, কিন্তু বিরোধী দলগুলির মুখে আজও সেই অভিযোগ ওঠে। এই প্রেক্ষাপটেই রাজ্য সরকারের আগামী বাজেট পেশ হতে চলেছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.