না, বন্ড মানে কেবল সেলুলয়েডের জেমস বন্ড নয়। বাজার অর্থনীতিতেও বন্ড আছে। বাংলায় যাকে বলে ঋণপত্র। বিনিয়োগকারীদের জন্য সরকারি ঋণপত্রে অ্যালোকেশন করা সুবিধাজনক। কারণ এই ধরনের ঋণে অনাদায়ের কোনও ঝুঁকি নেই। বিস্তারিত জানালেন শান্তনু গাঙ্গুলি
বন্ড কী এবং কেন ঋণপত্রের মাধ্যমে কেন্দ্রীয়, রাজ্য সরকার এবং নথিভুক্ত (লিস্টেড) কোম্পানি বাজার থেকে টাকা তোলে যখন প্রয়োজন হয়। সাধারণভাবে সরকার বন্ডের মাধ্যমে টাকা তোলে যখন বাজেট ঘাটতি হয়, অর্থাৎ সরকারের মোট খরচ, ট্যাক্স বাবদ এবং অন্যন্য আয় থেকে বেশি হয়। সরকারি ঋণপত্র ১ বছরের ভেতর ফেরতযোগ্য হলে তাকে ‘স্বল্পমেয়াদি মানি মার্কেট ইনস্ট্রুমেন্ট’ বলা হয়। এর অন্য নাম টি-বিল (t-bill)। স্বল্প মেয়াদে ভারত সরকার সাধারণত ৯১, ১৮২ এবং ৩৬৪ দিনের ভেতর ফেরতযোগ্য টি-বিল দ্বারা বাজার থেকে টাকা তুলতে পারে। টি-বিল ডিসকাউন্টে ছাড়া হয়। ধরা যাক ৯১ দিনের ১০০০ টাকার ফেস ভ্যালু বন্ড ৯৯৯ টাকায় ছাড়া হল। এই ১ টাকা ডিসকাউন্ট আসলে ৯১ দিনের সুদ। বাৎসরিক হিসেবে এই সুদের পরিমাণ (yield) দাঁড়ায় ৪%। দীর্ঘমেয়াদি (১ বছরের বেশি) ঋণপত্র যার পরিভাষা বন্ড (্bond), ১ বছর থেকে শুরু করে ৪০ বছরের মেয়াদ পর্যন্ত বাজারে ছাড়া যেতে পারে। বিনিয়োগকারীর পক্ষে সরকারি ঋণের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, এই ঋণের কোনও অনাদায়ের (default) ঝুঁকি নেই। বিনিয়োগকারীরা সময়মত সুদ পাওয়া এবং মূলধন ফেরতের দিক থেকে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
নথিভুক্ত কোম্পানিরা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিতে পারে বাজার থেকে বন্ড বা ডিবেঞ্চারের মাধ্যমে। কর্পোরেট বন্ড সাধারণত ছাড়া হয় কোনও বড় প্রজেক্ট সম্পাদনের জন্য। যেমন কারখানা, কমার্শিয়াল কমপ্লেক্স নির্মাণ ইত্যাদি। ফিনান্স-এর পরিভাষায় এই খরচকে ক্যাপেক্স (Capital Expenditure) বলা হয়।
কর্পোরেট বন্ড-এর ফেরত যোগ্যতার ঝুঁকি থাকার জন্য আইন অনুযায়ী এদের রেটিং করানো হয় স্বীকৃত রেটিং এজেন্সি (যেমন ICRA, CRISIL) দ্বারা। রেটিং এজেন্সি কোম্পানির আর্থিক অবস্থা যেমন লাভ/ক্ষতি, পরিসম্পদ এবং অন্যান্য বিষয় যাচাই করে বিভিন্ন রকম রেটিং দিয়ে থাকে। যেমন AAA মানে সর্বোচ্চ সুরক্ষা–অর্থাৎ বিনিয়োগকারী নিশ্চিত থাকতে পারেন সুদ এবং আসল সময়মতো ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে। AA মানেও উচ্চ সুরক্ষা কিন্তু AAA থেকে সামান্য কম। এইভাবে মোট আট রকম রেটিং আছে। সর্বনিম্ন হল ডি–অর্থাৎ Default শ্রেণীভুক্ত। এই বন্ডের ফেরতযোগ্যতার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এগুলিকে ‘জাঙ্ক বন্ড’ বলে। প্রশ্ন হল, কোনও বিনিয়োগকারী AAA শ্রেণির নিচের রেটিং-এর বন্ডে কেন বিনিয়োগ করবেন? এখানেই আসছে ফিনান্স তত্ত্বের ‘Risk and Return Trade-off’-এর বহুচর্চিত বিষয়টি। নিম্ন রেটিং বন্ডের আয় (yield ) উচ্চতর রেটিং বন্ডের আয় থেকে বেশি হবে কারণ প্রথমটি তুলনামূলকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ টাকা ফেরতের প্রশ্নে। যার ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা (risk appetite) বেশি, সে বেশি রিটার্ন পাওয়ার জন্য নিম্ন রেটিং বন্ডে বিনিয়োগ করবে।
বন্ডে বিনিয়োগ, অর্থনীতি, এবং সুদ যদিও খাতায় কলমে একজন খুচরো বিনিয়োগকারী আরবিআই– রিটেল ডাইরেক্ট গিল্ট-এর মাধ্যমে সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করতে পারেন, কিন্তু এই মাধ্যমটি বিভিন্ন কারণে জনপ্রিয় নয়। খুচরো বিনিয়োগকারী বন্ড মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করে লাভ ঘরে তুলতে পারেন। একটি মূল বিষয় মনে রাখতে হবে। যদিও সরকারি বন্ডে বিনিয়োগে অনাদায়ের সম্ভবনা নেই, কিন্তু এই বন্ডের দাম কমা বা বাড়া অর্থনীতিতে সার্বিক সুদের হার বাড়া এবং কমার ওপর নির্ভরশীল। মানে সরকারি বন্ডের সুদের হারের ঝুঁকি (ইন্টারেস্ট রেট রিস্ক) পূর্ণ মাত্রায় আছে। ২২-২৩ সালে মুদ্রাস্ফীতি কমাবার জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্ক প্রত্যেক কোয়ার্টারে রেপো রেট বাড়িয়েছে। সুদের হার নির্ভর করে সরকারি নীতি, মুদ্রাস্ফীতি এবং আমদানি-রফতানি ইত্যাদির ওপর। ২২-২৩ সালে মুদ্রাস্ফীতি কমাবার জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্ক প্রত্যেক কোয়ার্টারে রেপো রেট বাড়িয়েছে। রেপো রেট মানে কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক যে হারে সুদে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ধার করে।
যখন মুদ্রাস্ফীতি বাড়ে, বাজারে টাকার জোগান কমানোর জন্য আরবিআই রেপো রেট বাড়িয়ে দেয়–এতে ব্যাঙ্ক ধার করা কমিয়ে দেয় আরবিআই থেকে, ব্যাঙ্কের ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা ব্যাহত হয়, অর্থনীতিতে সঙ্কোচন হয়। কিন্তু ঋণের যদি চাহিদা থাকে, জনগণের থেকে ডিপোজিট নিতে হয় চড়া হারে ঋণের চাহিদা মেটানোর জন্য–এতে সরকারি বন্ডের রেট বেড়ে যায় পরোক্ষভাবে। টাকার যোগান কমানোর আর একটি উপায় হলো চড়া সুদে বাজার থেকে টাকা তোলা (ওপেন মার্কেট অপারেশন)। বর্তমানে সরকার রেপো রেট বাড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতি কমাতে চাইছে, বন্ড আকর্ষণীয় হচ্ছে কারণ বন্ডের ইল্ড বাড়ছে। ফলে যারা ঝুঁকি নিতে চান না, বন্ড ফান্ডে বিনিয়োগ করতে পারেন বেশি রোজগারের আশায়।
প্রশ্ন, যদি ভবিষ্যতে সুদের হার কমে, তখন কী হবে? সুদের হার কমলে বাজারে বন্ডের দাম বাড়ে, তখন বন্ড বেচে মূলধনী লাভ ঘরে তোলা যেতে পারে। তবে সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ এবং তার থেকে ঝুঁকিহীন রোজগার ব্যাপারটি একটু টেকনিকাল। অভিজ্ঞ মিউচুয়াল ফান্ড পরামর্শদাতা যিনি সার্বিক অর্থনীতি, আরবিআই-এর মনিটারি পলিসি ইত্যাদি বিষয়ে পারিদর্শী, তঁার সাহায্য নিতে পারেন।
(লেখক ফিনান্সের অধ্যাপক)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.