সহজ বুদ্ধি বলে, হাতে সঞ্চয় থাকলে বিনিয়োগ করা সম্ভব। হাতে টাকা এলে আমরা অনেকেই ব্যাংকে দীর্ঘমেয়াদি আমানত করি। কেবল সেই বিনিয়োগের সঙ্গে আমরা যে বিনিয়োগের কথা বলছি, তার অনেক তফাত। একটু ভাবলেই দেখা যাবে যে, ব্যাংকের সঞ্চিত অর্থ জিনিসপত্রের বিনিয়োগের কাজে নাই লাগতে পারে। জিনিসপত্রে বিনিয়োগ করে যদি ভবিষ্যতে লাভের সম্ভাবনা থাকে তবেই বিনিয়োগ করা হবে। কলমে দীপংকর দাশগুপ্ত
২০ সেপ্টেম্বর ‘অর্থনীতিকথা’ কলামে একটি সমীকরণের হদিশ পেয়েছিলাম। সমীকরণটি হল সামাজিক আয় = সামাজিক উৎপাদন = সামাজিক উপভোগ + সামাজিক বিনিয়োগ।
সামাজিক আয় এবং সামাজিক উৎপাদনের মধ্যে যে কার্যত কোনও প্রভেদ নেই- সেকথা আমরা অনেক আগেই জেনেছিলাম। সমীকরণটি নতুন যে-কথা শেখাল, তা হল সামাজিক উৎপাদনকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়, উপভোগ ও বিনিয়োগ। ‘উপভোগ’ শব্দটির অর্থ বুঝতে অসুবিধা হয় না যদি পরিষেবাকে তার সঙ্গে জুড়ে নেওয়া হয়। ‘বিনিয়োগ’ ব্যাপারটা অবশ্য আলোচনা সাপেক্ষ এবং এর আগের পক্ষে তাই নিয়ে কথা হয়েছিল। কেবল সমীকরণটি নিয়ে আরেকটু আলোচনা বাকি আছে। সেই আলোচনার জন্য উৎপাদনের পরিবর্তে আমাদের আয় থেকে শুরু করতে হবে।
এ ব্যাপারটা অনেক সহজ, কারণ আয় কী- সে সম্পর্কে আমরা প্রত্যেকেই অবগত। এবং আয় আর ব্যয়ের মধ্যে যোগাযোগটা কী, তাও আমাদের জানা। যদিও ‘যত্র আয় তত্র ব্যয়’ এমন মানুষের অভাব নেই, তবুও সমাজের অধিকাংশ মানুষই আয়ের একটি অংশ উপভোগের জন্য ব্যবহার করেন এবং বাকি অংশটুকু সঞ্চয় করেন। অতএব এই সহজবোধ্য ব্যাপারটাকে আবারও সমীকরণের আকারে লেখা যায়। সামাজিক আয় = সামাজিক উপভোগ + সামাজিক সঞ্চয়।
এবার এই সমীকরণটিকে উপরের সমীকরণের সঙ্গে জুড়ে দিলে আমরা একটি নতুন তথ্যের সন্ধান পেয়ে যাই। এই তথ্যটি অর্থনীতির ক্লাসঘরে সকলেই জানেন, কিন্তু আমার প্রতিবেশী বোধহয় জানেন না। না জানলে খুব বেশি ক্ষতি হয়তো নেই, কারণ দেশের অর্থনীতির হালচাল নিয়ে মন্তব্য করতে তঁার বা আরও অনেকেরই বিশেষ অসুবিধা হয় না। দু’টি সমীকরণকে জুড়ে দিলে আমরা দেখতে পাই, সামাজিক উপভোগ + সামাজিক সঞ্চয় = সামাজিক উপভোগ + সামাজিক বিনিয়োগ।
এবার অর্থনীতির সুবিখ্যাত একটি উপপাদ্যে আমরা এসে উপনীত হলাম, সামাজিক বিনিয়োগ = সামাজিক সঞ্চয়। যে কেইন্সকে নিয়ে আমরা অনেক লাফালাফি করে থাকি, তিনিই প্রথম এই তত্ত্বটির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। আর এর মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে তাঁর অর্থনৈতিক মন্দা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা। কিন্তু সেই তত্ত্বে যাওয়ার আগে, ‘সঞ্চয়’ শব্দটিকে একটু নতুন চোখে দেখে নেওয়া দরকার।
সঞ্চয় বলতে কী বোঝায়, তা তো আমরা প্রত্যেকেই জানি, তাই না? আয়ের যে-অংশ খরচ করা হল না, সেটাই সঞ্চয়। অবশ্যই তাই। তবে আমাদের আলোচনা যেভাবে এগিয়েছে তার মধ্যে সঞ্চয়ের অপর একটি অর্থও লুকিয়ে আছে। উৎপাদনের যে অংশ ভোগ্যপণ্য আকারে ব্যবহৃত হল না, তা একাধারে বিনিয়োগও বটে আবার অন্যভাবে দেখলে সঞ্চয়ও। অর্থাৎ, সঞ্চয় কেবল আপনার জমানো টাকা নয়। উৎপাদনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে যে সমস্ত উৎপাদিত জিনিস ভোগ্যপণ্য হিসাবে বিক্রি হল না, তা-ই হল সঞ্চয়।
যদি আপনি এর আগের পর্বের ‘অর্থনীতিকথা’ পড়ে থাকেন, তবে বিনিয়োগের মানেও আপনার অজানা নয়। বছরের শেষে যে সমস্ত জিনিসপত্র পড়ে রইল, তার থেকে বছরের গোড়ায় যে জিনিসপত্র ছিল তা বাদ দিলেই বিনিয়োগের অঙ্ক পাওয়া যায়।
এই বিয়োগফলকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে সেই সমস্ত জিনিস যা উৎপাদকরা কিনেছেন, কারখানা, যন্ত্রপাতি, অর্ধসমাপ্ত জিনিসপত্র, দোকানদাররা বিক্রি করার জন্য নতুন যত ভোগ্যপণ্য কিনেছেন, এমন আরও অনেক কিছু। কিন্তু এই পড়ে থাকা জিনিসপত্রের মধ্যে এমন সমস্ত জিনিসও রয়েছে যেগুলি তৈরি হয়েছে কিন্তু বিক্রি হয়নি চাহিদার অভাবে। অর্থাৎ উৎপাদকের গুদামঘরে নতুন গাড়ি তৈরি হয়ে পড়ে রয়েছে কিন্তু তার কোনও চাহিদা নেই। সেটি ক্রেতার ঘরে যায়নি। তাই বিনিয়োগের মধ্যে দুই ধরনের জিনিসপত্র রয়েছে। প্রথম সেই সমস্ত জিনিস যার জন্য চাহিদা আছে। সেই চাহিদা অন্তিম ক্রেতার বা উৎপাদকদের উৎপাদন হিসাবে চাহিদা হতে পারে, শাড়ি, গয়না, গাড়ি, বাড়ি, যন্ত্রপাতি- এমন অনেক কিছু। দ্বিতীয়, সেই সমস্ত জিনিস যা তৈরি হয়েছে কিন্তু বিক্রি হয়নি। সেখানেও গাড়ি, শাড়ি থাকতে পারে, কেবল সেসব জিনিস উৎপাদকের গুদামে পড়ে রয়েছে। সব মিলিয়ে চাহিদা থাকুক আর না-ই থাকুক, সবটুকুরই নাম বিনিয়োগ। কাজেই বিনিয়োগের মধ্যে দুই ভাগ। সেই সমস্ত জিনিস যার জন্য চাহিদা রয়েছে এবং সেই সমস্ত জিনিস, যার জন্য চাহিদা নেই।
আর আমরা ইতিমধ্যে এটা জানি যে, সমস্ত বিনিয়োগের অঙ্ক যোগ করলে যা পাওয়া যায় তার অপর নাম সঞ্চয়। কাজেই আমরা সংসারের টাকা বাঁচিয়ে যে টাকা ব্যাংকে রাখি, তা সঞ্চয় ঠিকই, কিন্তু মোট সঞ্চয় আবার দুই ধরনের জিনিসপত্রের উপর বিনিয়োগে বিভক্ত। যে বিনিয়োগের জন্য চাহিদা আছে এবং যে বিনিয়োগের জন্য চাহিদা নেই। সঞ্চয় সবসময়ই বিনিয়োগের সমান, কিন্তু বিনিয়োগের জিনিসপত্রের মধ্যে যে অংশটুকুর জন্য চাহিদা নেই, সেই অংশটুকু কম হলে অর্থনীতির স্বাস্থ্য ভাল। সেটাই মন্দার লক্ষণ। বেশি হলে স্বাস্থ্য ভাল নয়।
এবার একটি নাটকীয় কথা দিয়ে শেষ করা যাক। সঞ্চয় আগে না বিনিয়োগ আগে? সহজ বুদ্ধি বলে, হাতে সঞ্চয় থাকলে বিনিয়োগ করা সম্ভব। হাতে টাকা এলে আমরা অনেকেই ব্যাংকে দীর্ঘমেয়াদি আমানত করি। কেবল সেই বিনিয়োগের সঙ্গে আমরা যে বিনিয়োগের কথা বলছি, তার অনেক তফাত। একটু ভাবলেই দেখা যাবে যে, ব্যাংকে র সঞ্চিত অর্থ জিনিসপত্রের বিনিয়োগের কাজে না-ই লাগতে পারে। জিনিসপত্রে বিনিয়োগ করে যদি ভবিষ্যতে লাভের সম্ভাবনা থাকে, তবেই বিনিয়োগ করা হবে। করোনা আসার পর দেখা গেল উপভোগের প্রবণতা কমে গিয়ে সঞ্চয় বৃদ্ধি পেল। কিন্তু জিনিসপত্রের বিনিয়োগের চাহিদা বাড়ল না, কারণ বিনিয়োগ করে লাভের থেকে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি ছিল। জিনিসপত্র তৈরি হয়ে শ্রমিক শ্রেণির যা আয় হয়েছে, তার থেকেই সঞ্চয় হয়েছে। কাজেই সঞ্চয় অনেক বেড়ে যাওয়া জিনিসপত্র তৈরি হওয়ার লক্ষণ হলেও, সেই জিনিসপত্র অবাঞ্ছিত বিনিয়োগেও হতে পারে। গুদামে পড়ে থাকা জিনিসপত্র, যা খরচ করে তৈরি হয়েছে কিন্তু যা বিক্রি করে লাভ তোলা যায়নি। কাজেই সঞ্চয় থাকলেই ইচ্ছাকৃত বিনিয়োগ হবে এমন নয়। সেই বিনিয়োগ দিয়ে অর্থনীতির উন্নতি হবে না।
কিন্তু উৎপাদকরা যদি প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করেন, অর্থাৎ বিনিয়োগের জন্য উৎপাদিত জিনিস কেনেন, গুদামে বিক্রি না হওয়া জিনিস কম থাকে, তবেই অর্থনীতির উন্নতি সম্ভব। এবং সেক্ষেত্রেও কিন্তু বিনিয়োগ ও সঞ্চয় সমান। কেবল বিনিয়োগটা আগে, সঞ্চয়টা তার ফল।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.