এখনও ভারতের আর্থ-সামাজিক স্রোতে মহিলারা মূলস্রোতের বাইরে। পেনশন ক্ষেত্র দিয়েই সেখানে পরিবর্তন আনা সম্ভব। অবসরের পর পেনশন হাতে পাওয়া, নিয়মিতভাবে এবং দীর্ঘদিন ধরে চালানো সঞ্চয় প্রকল্পের সুফল পাওয়া, এমন কে না চায়? মেয়েদের জন্য তা বিলক্ষণ দরকার। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে বীজ পুঁতলে, ডালপালা বেরিয়ে আসা কেবল সময়ের অপেক্ষা। কলমে নীলাঞ্জন দে
জেন্ডার নিয়ে বিশ্লেষণ কম নেই। বিশেষ করে যখন নারী-পুরুষের ভেদাভেদ আজ এতভাবে প্রকট, এতটাই প্রাঞ্জল যে, স্রেফ এরই ভিত্তিতে দিস্তা-দিস্তা পাতা সমীক্ষার ফল প্রকাশ করা সম্ভব। এমন ভেদাভেদ এবং মহিলাদের সার্বিকভাবে পিছিয়ে থাকার অন্যতম প্রতিফলন সেভিংস এবং ইনভেস্টমেন্টে।
ভারতে গড়-হাউসহোল্ড বাজেটে বাড়ির মেয়েদের অংশীদারি তুলনায় বেশ কম, পুরুষরা সমস্ত বিষয়ে এগিয়ে। আমাদের সামগ্রিক সমাজব্যবস্থার ছবি এই সংক্রান্ত পরিসংখ্যান দিয়ে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। পরিসংখ্যানের বহর বাড়িয়ে লাভ নেই, স্ট্যাটিসটিক্সের ধাক্কায় এই লেখার মূল প্রতিপাদ্য হারিয়ে যাবে। আজ আলোচনা করব সেভিং এবং ইনভেস্টমেন্টের বিশেষ এক প্রসঙ্গ নিয়ে- পরিকল্পিত পেনশনে মহিলাদের অংশগ্রহণ। নেপথে্য থাকবে ‘ন্যাশনাল পেনশন সিস্টেম ট্রাস্ট’-এর দেওয়া এই সংক্রান্ত সর্বশেষ তথ্য। আগেই বলে রাখি, ন্যাশনাল পেনশন সিস্টেম ট্রাস্ট নিয়ে দু’-চার কথা।
আধুনিক প্রজন্মের হাতে রিটায়ারমেন্ট প্ল্যানিং করার অস্ত্র তুলে দিয়েছে ‘এনপিএস’। ঘোষিত সরকারি নীতি অনুযায়ী শুধু গভর্নমেন্ট সারভেন্ট-ই যে কেবল নতুন পেনশন প্রকল্পের অন্তর্গত হতে পারবেন, তা নয়। সাধারণ নাগরিকও আজ ‘অল সিটিজেন’ মডেল ব্যবহার করে এনপিএস গ্রাহক হতে পারেন। সরকারি চাকরির সঙ্গে সম্পর্কহীন বহু মানুষ ইতিমধ্যে এই প্রকল্পে সাবস্ক্রাইবার হয়েছেন, আগামী দিনে গ্রাহক সংখ্যা যে বাড়বে, তা জোর গলায় বলা চলে। সার্বিকভাবে রিটায়ারমেন্ট প্ল্যানিং নিয়ে নতুন চিন্তাভাবনা করছে ভারতবাসী। রিফর্ম যে ফলপ্রসূ হয়েছে, তা বলতে কুণ্ঠা নেই। তবে ১৪২ কোটির দেশে ‘সবার জন্য পেনশন’ আজও টেক্সট বুক এবং স্লোগানেই আবদ্ধ।
যাক সে-কথা। ফিরে আসি মেয়েদের অংশগ্রহণে। সুখের বিষয়, গত তিন বছরে তাদেঁর সংখ্যা বাড়ছে- যদিও পুরুষদের তুলনায় সেখানে বৃদ্ধির হার কম। আর্থিক বর্ষ ২০২০, ২০২১ এবং ২০২২-এ, মহিলা সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ছিল ১.৪২ কোটি, ১.৭৭ কোটি ও ২.১৯ কোটি। উল্লেখ্য, পুরুষদের সংখ্যা এই তিন বছরে এক কোটির বেশি বেড়ে ২০২২ সালে পৌঁছেছে ৩.০১ কোটিতে। ‘অ্যাবসোলিউট’ পরিসংখ্যানের নিরিখে এই বিষয়টি হয়তো মনে আলাদা কোনও দাগ কাটবে না। তবে যদি জেন্ডার-ভিত্তিক ডিস্ট্রিবিউশন দেখেন, তাহলে বুঝবেন ‘মেল টু ফিমেল’ রেশিও তেমনভাবে বদলাচ্ছে না। তার মানে নারী-পুরুষ ভাগাভাগির সংখ্যায় স্থিতাবস্থা। এই স্থিতাবস্থা কাম্য নয়, এবং এখানেই অনেক উন্নতির প্রয়োজন। আগে পৃথিবী যেমন ছিল, তা এখন আর নেই, মেয়েদের আর্থিক স্বাধীনতা আজও তুলনায় অনেকটাই কম। স্থায়ী পেনশন ফান্ডে বিনিয়োগ করবেন পুরুষ, পরিবারের অন্যজন নন, এই ব্যবস্থার বদল দরকার। চট করে জেন্ডার-ভিত্তিক ব্রেকআপের প্রসঙ্গটি শেষ করি। শুধু আরও একটি শুকনো তথ্য: ৩১ মার্চ, ২০২২ সালের শেষের অবস্থা বোঝাতে। পুরুষের ভাগ (মোট সাবস্ক্রাইবারে) যেখানে ৫৮ শতাংশ, মহিলাদের ভাগ সেখানে ৪২ শতাংশ। সুতরাং এই সমস্যা ঠিক এখনই যে শুধরে যাবে, তা নয়।
এ-কথা পরিষ্কার যে, ভারতীয় নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে ফিন্যানশিয়াল প্ল্যানিংয়ের নিরিখে। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা (টাটা এআইএ জীবন বিমা সংস্থার করা) বলছে, মাসের বাজেটে গড়পড়তা অংশগ্রহণ বেড়েছে মেয়েদের, যদিও স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে তাঁরা অনেকটাই পিছিয়ে। তবে, সমীক্ষা এ-ও জানাচ্ছে, ৪০ শতাংশের বেশি মহিলা সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অপেক্ষাকৃত ছোট শহরে (‘টিয়ার টু’ যেগুলোকে বলা হয়) এর প্রতিফলন বেশি দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা। লাইফস্টাইলে পরিবর্তন, টেকনোলজির আবির্ভাব এবং রোজগার বাড়ায় এমন পরিবর্তন আসতে চলেছে। তবে আগামী দিনেও মেয়েরা তঁাদের পরিবারের আর্থিক সুরক্ষার প্রতি নজর দেবেন, প্রাধান্য দেবেন, এমনই বোঝা যাচ্ছে। আমার মতে, রিটায়ারমেন্ট প্ল্যানিং, বিশেষত পেনশনের ক্ষেত্রে, এই পরিবর্তিত চিত্র বেশি করে চোখে পড়বে। হয়তো আরও বছর দশেক অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। বেশ কয়েকটি ব্যাপারে বদলের ইঙ্গিত তো এখনই পাওয়া যাচ্ছে। এনপিএসের মোট গ্রাহক সংখ্যায় মহিলাদের অংশে কী ধরনের বৃদ্ধি হয়, তা থেকেও কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যাবে। সুখবরের অপেক্ষায় রইলাম। আগে যে ‘অলসিটিজেন’ মডেলের কথা বলেছি, সেখানে গ্রোথের সম্ভাবনা আছে, এমনই অনেকের ধারণা। কাজেই সেদিকে বিশেষভাবে নজর রাখা দরকার।
এখানে বলে রাখা উচিত, ভারতে মেয়েদের আর্থিক অসচ্ছলতা কোনও নতুন খবর নয়। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই যা হয়ে চলেছে বহুকাল ধরে, এখানেও তার ব্যতিক্রম নেই। পরিবারের আর্থিক হাল ধরেন পুরুষ-ই, ইনভেস্টমেন্টের সিদ্ধান্ত তিনিই নিয়ে থাকেন। এ-যুগেও সঞ্চয় কীভাবে হবে, ফিক্সড ডিপোজিটে না মিউচুয়াল ফান্ডে, এই জাতীয় বিষয়ও তাঁর দায়িত্ব। পেনশন ফান্ডে বিনিয়োগ কতখানি হবে (আদৌ যদি তা হয়, কারণ পেনশন নিয়ে সামগ্রিক জ্ঞান কম এই দেশে, সুযোগেরও অভাব প্রকট) তা তিনি ঠিক করবেন, এ-ও দেখতে পাচ্ছি। সব মিলিয়ে মেয়েরা কোণঠাসা হয়েই রয়েছেন আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে।
ভবিষ্যৎ কোনদিকে নিয়ে যাবে পেনশনের সন্ধানে থাকা মহিলাদের? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া অতীব কঠিন, কার্যত অসম্ভবও বলা চলে। তাও বলি, ডিজিটাল মন্ত্রে দীক্ষিত মেয়েরা অনেকাংশে এগিয়ে যেতে পারবেন। ‘ফিনটেক’ নিয়ে কার্যকলাপে ব্যস্ত যাঁরা, তাঁরাও এমনই বলেন। তাঁদের মতে ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ পেরিয়ে উঠে আসবেন অগণিত নারী। মাইক্রো পেনশনের উদাহরণ পাই তাঁদের কাছ থেকে। সাধারণ স্বল্প উপার্জনকারী পরিবারের জন্য অবসরকালীন পরিকল্পনা করা সম্ভব মাইক্রো পেনশন প্রকল্পের ব্যবহারে। মাইক্রো, অর্থাৎ ক্ষুদ্র প্রকল্পের সদ্ব্যবহার করা যায় মার্কেটে লগ্নির ক্ষেত্রেও। ‘মাইক্রো সিপ’, আমাদের জন্য দ্বিতীয় উদাহরণ, বেশ কার্যকর হতে পারে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হলে।
আর্থ-সামাজিক স্তরবিন্যাসের নিচের দিকে যাঁদের অবস্থান, তাঁরা প্রাথমিকভাবে সামান্য অর্থ দিয়ে শুরু করতে পারেন। নির্দিষ্ট প্রকল্পে বিনিয়োগ করে সঞ্চয় বৃদ্ধির পরিকল্পনা এভাবেই শুরু হওয়া উচিত। গণ্ডির বাইরে রয়ে গিয়েছেন যাঁরা, আর্থিক ব্যবস্থায় অংশ নেওয়া যাঁদের হয়ে ওঠেনি (মহিলাদের কথা বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে এক্ষেত্রে), তাঁদের পক্ষে ক্ষুদ্র সেভিংস তথা পেনশন খুব সহায়ক হতে পারে। মাসে ২০০ টাকা দিয়েও আরম্ভ করা যায় এমন প্রকল্পের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, তাই খুঁজে নিতে দেরি করা ঠিক নয়। মহিলারা- এছাড়াও সদ্য ‘মেজর’ হয়েছেন যাঁরা- এভাবেই সঞ্চয় বাড়াতে পারেন। মেনস্ট্রিমে প্রবেশ করা সহজতর করতে মাইক্রো প্রকল্পের জুড়ি নেই। অবশ্য ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট এবং ‘কেওয়াইসি’ সংক্রান্ত নিয়মের শর্ত মানতে হবে, নচেৎ এত সহজে অংশ নেওয়া অসম্ভব। পেনশনের ক্ষেত্রে ‘অর্গানাইজড সেক্টর’ যে ভূমিকায় দেখতে আমরা অভ্যস্ত, তা ইনফর্মাল ইকোনমিতে দেখা অসম্ভব হবে আগামী দিনেও। তবে ইনফর্মাল হোক বা অর্গানাইজড, মহিলারা দু’ক্ষেত্রেই পিছিয়ে। বয়স-কালে পেনশন তাঁদের ভাদ্যে প্রায় নেই, পুরুষরাই এগিয়ে।
ভারতের সামাজিক ন্যায় বা সাম্য যা-ই বলুন, পিছিয়ে থাকা গোষ্ঠীর অভাব নেই। আর্থ-সামাজিক শ্রেণি সমূহে নানাভাবে মহিলারা মূলস্রোতের বাইরে। পেনশন ক্ষেত্র দিয়েই সেখানে পরিবর্তন আনা সম্ভব। নীতির উদারিকরণ প্রয়োজন, না হলে যথেষ্ট সংখ্যক মেয়ে সুযোগ পাবেন না, পিছিয়েই থাকবেন। তা কখনই কাম্য নয়। একত্রে আনতে হবে, এক ছাতার তলায়, স্বনির্ভর গোষ্ঠী এবং কর্পোরেটিভ পদ্ধতিতে চলা ব্যবস্থাগুলো। তাহলে নতুন পলিসি কার্যকর করা সহজতর হবে, যদিও তার জন্য চাই বৃহৎ কর্মকাণ্ড সামলানোর মতো দক্ষ সঞ্চালকদের।
অবসরের পর পেনশন হাতে পাওয়া, নিয়মিতভাবে এবং দীর্ঘদিন ধরে চালানো সঞ্চয় প্রকল্পের সুফল পাওয়া, এমন কে না চায়? মেয়েদের জন্য তা বিলক্ষণ দরকার। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে বীজ পুঁতলে, ডালপালা বেরিয়ে আসা কেবল সময়ের অপেক্ষা। বীজ পুঁততে হবে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে, এখনকার পেনশনের নিয়মকানুন মেনেই। এনপিএস সাবস্ক্রাইবারদের একটি বড় অংশ বাজারে অাস্থা রাখেন, তঁারা মার্কেট-নির্ভর রিটার্ন চান। পৃথিবীর নানা কোণে এই ব্যবস্থা চালু আছে, ফলও পেয়েছে সেই সমস্ত দেশ। মহিলা হোন বা পুরুষ, আপনার পেনশন কীভাবে আসতে পারে, কবে থেকে নিয়মিত হারে টাকা পেতে চান, সেসব জরুরি সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনাকেই। কালক্ষেপে ক্ষতি হবে, তাই শুভস্য শীঘ্রম। মেয়েরা যেন এই শেষকথাটি বিশেষভাবে অনুধাবন করেন।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক বিনিয়োগ উপদেষ্টা
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.