‘চল যাত্রী, চল’ দিনরাত্রি। জীবনের সেটাই নিয়ম। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সেই যাত্রা যেন শেষপর্যন্ত সুগম হয়, অবাধ হয়। অবসরের পরেও যেন ‘ভাল’ থাকতে পারে সমস্ত দেশবাসী, তবেই প্রকৃত অর্থে স্বাধীন হবেন সকলে। পেনশন-ইনভেস্টমেন্ট এবং রিটায়ারমেন্ট সেভিংস যদি যথাযথ না হয়, জীবনের শেষ অধ্যায়ে জমতে বাধ্য খেদ আর দীর্ঘশ্বাসের বাষ্প। তাই সঞ্চয়ের গুরুত্ব বুঝুন। কলমে সুপ্রতীম বন্দ্যোপাধ্যায় , চেয়ারম্যান, পেনশন ফান্ড রেগুলেটরি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (পিএফআরডিএ)
স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তিতে আমরা এক যুগের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। বয়স্ক নাগরিকদের আর্থিক সুরক্ষা দেওয়া আর দেশের সকলকে, বিশেষ করে যাঁরা এখন কর্মরত, তাঁদের আর্থিক স্বতন্ত্রতার পথ প্রদর্শন করানো আমাদের পরম কর্তব্য। উদ্দেশ্য খুবই সাধু, আর তা হল-অবসরের পরও যাতে দেশের প্রবীণ নাগরিকরা নিজেদের যাবতীয় প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম থাকেন এবং সর্বোপরি ভাল থাকতে পারেন-সেই পদক্ষেপ নেওয়া।
স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং নিকাশি ব্যবস্থার উন্নতি আর পরিচ্ছন্নতার বৃদ্ধির ফলে গড় আয়ু এদেশে এখন ৭০ বছরে পৌঁছেছে, যা স্বাধীনতার সময় ছিল ৩৫ বছরের কাছাকাছি। আগামী কয়েক দশক, ২০২০ থেকে ২০৫০ এর মধ্যে, প্রায় ১৯ কোটি মানুষ ‘ওয়ার্কিং এজ গ্রুপ’ তালিকার অন্তর্ভুক্ত হবেন। এক দিকে এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড আমাদের জন্যে একটি গর্বের এবং আনন্দের বিষয়, অন্য দিকে এটা একটি চিন্তারও কারণ। এর ফলে ভারতবর্ষে বয়স্ক মানুষ তথা প্রবীণদের সংখ্যা বেড়ে ২৩ কোটি ছাড়িয়ে যাবে, এখন যার সংখ্যা কেবল ৬ কোটি। এর মানে দাঁড়াচ্ছে যে, ২০৫১ সালে আনুমানিক ২০ শতাংশ ভারতীয়র বয়স হবে ৬০ বছর বা তার বেশি। এটা মনে রাখা নেহাতই জরুরি যে, কাজ থেকে অবসরের গড় বয়সে কিন্তু খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। তার অর্থ এই যে, মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ অবসর নেওয়ার পর বেশ কিছু বছর জীবিত থাকবে এবং এঁদের জন্য বিকল্প আয়ের ব্যস্থা থাকা খুবই জরুরি। নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, পেনশন-ইনভেস্টমেন্ট এবং রিটায়ারমেন্ট সেভিংস যথাযথ না হলে এঁরা অনেকেই জীবনের সোনালী সময়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারবেন না।
উল্লেখযোগ্যভাবে, সাধারণ ভারতীয়র স্থাবর সম্পত্তিতে বিশ্বাস কিন্তু অটুট। রিজার্ভ ব্যাংকের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী পারিবারিক সঞ্চয়ের একটি বড় অংশ লগ্নি করা হয় স্থাবর সম্পত্তিতে, (রিয়েল এস্টেট বা জমিজমায় ৭৭ শতাংশ, সোনায় ১১ শতাংশ এবং অন্য ‘ডিউরেবল গুডস’-এ লগ্নি ৭ শতাংশ)। স্রেফ ৫ শতাংশ বিনিয়োগ হয় ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাসেটে। এর অন্য অর্থটিও খুব স্বচ্ছ এবং অত্যন্ত চিন্তাজনক। আর সেটি হল- আপদে-বিপদে আমাদের দেশে বেশিরভাগ মানুষের কাছে নির্ভরযোগ্য এমার্জেন্সি ফান্ডের ব্যবস্থা নেই। সেই কারণেই আপৎকালীন খরচ করতে হলে, বেশিরভাগ পরিবার নিজেদের পেনশন সেভিংস, যা অবসরের জন্য রাখা আছে, ভাঙিয়ে ফেলেন। আরবিআই-এর মতে, কেবল ২৩ শতাংশ মানুষ সক্রিয়ভাবে অবসরের জন্য সঞ্চয় এবং বিনিয়োগ করছেন। ৩৩ শতাংশ এখনও কোনও পরিকল্পনাই করেননি। এছাড়াও, একটি বড় অংশ, অন্তত ৪৪ শতাংশ আদৌ অবসরের কথা ভাবছেন না। ‘সেভ লেস, প্ল্যান লেস ফর রিটায়ারমেন্ট’-এটাই যেন এই দেশের বেশিরভাগ নাগরিকের মন্ত্র। এই মানসিকতা যে শুধু পরিবার-পরিজনবর্গের জন্য ক্ষতিকারক, তা-ই নয়। এটা সমগ্র দেশের ‘ফিসক্যাল হেলথ’ এর পক্ষেও বিপজ্জনক। ব্যক্তি তথা পরিবার, দুইয়ের জন্যই পেনশন রিটায়ারমেন্ট ফান্ড অপরিহার্য। না হলে দীর্ঘমেয়াদী এবং চড়া হারে সুদসমেত ‘আনসিকিওরড লোন’-এর ফাঁদে পড়তে হতে পারে।
আমাদের মনে রাখা উচিত যে ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা সহজে আসেনি। প্রাণপাত করে লড়াই করতে হয়েছিল। বহু বছরের পরাধীনতার গ্লানি মুছে, আমাদের স্বাধীনতা আনতে অগণিত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দেশবাসী নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ‘ফাইন্যান্সিয়াল ফ্রিডম’ মানে আর্থিক স্বাধীনতাও একদিনে আসবে না। নিয়ম করে এবং ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের। আর্থিক বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞানার্জন, যথাশীঘ্র পরিকল্পনা শুরু করা, সঠিক আর্থিক সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং নিয়মিত সঞ্চয় ও বিনিয়োগ করা-এই সব কিছুরই সর্বোচ্চ গুরুত্ব রয়েছে। নিজেদের জন্য নির্দিষ্ট রিটায়ারমেন্ট ফান্ড তৈরি এবং সে বিষয়ে ধৈর্য্যশীল থাকা, আমাদের মহাদায়িত্ব। আজ এই স্বাধীনতা দিবসে আসুন, সকল সহ-নাগরিকদের আর্থিক স্বাতন্ত্র্য এবং স্বাধীনতা অর্জন সুনিশ্চিত করতে আমরা দ্রুত পদে এগিয়ে এসে সাহায্য করি।
জয় হিন্দ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.