আমি বিনিয়োগের বাজারে পা রাখব অথচ ঝুঁকির মুখোমুখি হতে চাইব না। এমন মনোভাব থাকলে এই দুনিয়ায় আসবেনই না। সব কিছুতেই রিস্ক রয়েছে। ইনভেস্টমেন্টও তার ব্যতিক্রম নয়। তাই রিস্কের বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে, এই বাজারে লং টার্মে অস্তিত্ব বজায় রাখা দুরূহ হয়ে উঠতে বাধ্য। ব্যাখ্যায় জয়দীপ সেন
সোজা হিসাব সোজাসুজি বলাই উচিত। আপনি ইনভেস্ট করতে চান, ভাল কথা। তবে তার আগে ইনভেস্টমেন্ট আসলে কী, তা জেনে রাখুন। নিজের টাকা ইকুইটি, বন্ড, রিয়েল এস্টেট বা গোল্ডে যখন যথেষ্ট লম্বা দৌড়ের জন্য লগ্নি করবেন যথাযথ রিটার্নের জন্য, তা-ই ইনভেস্টমেন্ট হিসাবে গণ্য হবে। অনেক সময় দেখেছি, সাধারণ মানুষ বড় মাপের রিটার্ন পেতে চান, কিন্তু লম্বা দৌড়ের কথা মনে রাখেন না। তবে খেয়াল করে দেখুন, শর্ট টার্মে চটজলদি রোজগার করার স্পৃহা মানেই আপনি ঝুঁকি নিচ্ছেন। তার মানে বেশ পরিষ্কার-আপনি বড় মাপের রিটার্ন আশা করতেই পারেন, তবে ঝুঁকির বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা যেন গোড়াতেই থাকে। আরও সরলভাবে বলতে গেলে রিস্ক যদি না বোঝেন, তাহলে তেমন লগ্নি না করাই উচিত। আর এই যে একটু আগে লম্বা দৌড়ের উল্লেখ করলাম, জেনে রাখুন সেই রকম লগ্নির ক্ষেত্রেও যে ঝুঁকি থাকতে পারে না, তা নয়। সেখানেও রিস্ক থাকা অসম্ভব নয়, আর তা আপনার জন্য উপযুক্ত নাও হতে পারে।
সামান্য কয়েকটি উদাহরণ দিই। ধরা যাক, আপনি স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করেন। হয়তো সরাসরি করেন, মানে নিজেই শেয়ার নির্বাচন করে ব্রোকারের মাধ্যমে ট্রানজ্যাকশন করেন। অথবা মিউচুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে ইকুইটি মার্কেটে ইনভেস্ট করেন। যেভাবেই হোক, আপনি দশ বছরের ‘ইনভেস্টমেন্ট হোরাইজন’ ধার্য করেছেন। নিদেনপক্ষে পঁাচ বছর তো করবেনই। এই পদ্ধতিতে আপনি সত্যিই ইনভেস্টমেন্ট করছেন। এবার ধরুন, অন্য এক ছবি আমাদের সামনে উপস্থিত। সেখানে আপনি ইন্ট্রা-ডে ট্রেডিং করছেন, বা ফিউচার্স অ্যান্ড অপশনসে নিজের পজিশন নিতে বিশ্বাসী। এই দ্বিতীয় পদ্ধতি কিন্তু আমার পরিভাষায় ইনভেস্টমেন্ট হিসাবে গণ্য হবে না।
এখানে বলে রাখা উচিত যে আমি এক মুহূর্তের জন্যও কিন্তু ইন্ট্রা-ডে ট্রেডিংয়ের বিরুদ্ধে কিছু বলছি না। অথবা ইকু্যইটি ডেরিভেটিভসের সমালোচনাও করছি না। অন্য অনেক পদ্ধতির মতো, এসব ক্ষেত্রেরও যথেষ্ট মূল্য আছে, তাকে মান্যতা দিতেই হবে। এ যুগের মার্কেটে এই সমস্ত প্রক্রিয়ার সঙ্গে অনেকে যুক্ত, তা কখনওই ভোলা যায় না। আমার প্রশ্ন একেবারে ভিন্ন-এক, আপনি কি এই পদ্ধতির বিষয়ে সম্যক বোঝেন, ভাল ধ্যান-ধারণা আছে? দুই, এই প্রক্রিয়া কি নির্দিষ্টভাবে আপনার জন্য উপযুক্ত? জানেনই তো, সব কিছু সকলের জন্য নয়। পৃথিবীর নামকরা কুস্তিগীররা অর্থ এবং খ্যাতি, দুই-ই পেয়ে থাকেন। কিন্তু তা বলে কি আমি-আপনি কুস্তির সব প্যাঁচ-পয়জার না জেনে একইভাবে তা পাব? মোদ্দা কথা, ইন্ট্রা-ডে ট্রেডিং ইত্যাদি সোজা নয়, কেবল মিডিয়ার অ্যানালিসিস পড়ে বা ইউটিউবে ভিডিও দেখেই এগুলি আয়ত্বে আনা যায় না।
এবার অন্য এক প্রসঙ্গে আসি। স্টক মার্কেটে প্রায়ই শুনবেন, অমুক শেয়ার ‘মাল্টি-ব্যাগার’। স্বল্প সময়ে মাল্টি-ব্যাগার স্টক পেয়ে গিয়েছেন কোনও সৌভাগ্যবান ইনভেস্টর, এমন তো শোনাই যায়। সেখানে কিন্তু তিনি ‘স্পেকুলেট’ করেছেন, জেনে রাখবেন। অর্থাৎ, জেনে বুঝেই ধারণা করে নিয়েছেন যে স্টকটি খুব দ্রুত বাড়বে। হ্যাঁ, তা অবশ্যই সম্ভব, তবে ঝুঁকির মাত্রা যে যথেষ্ট বেশি ধরনের ছিল, তা তো অস্বীকার করা যায় না। আপনি কী বলেন? সাধারণ লগ্নিকারীদের দেখি, অন্যের ট্র্যাক রেকর্ড খুব নজর করেন, আর অনেক সময় অনুসরণ করেন। অতীতে যদি কেউ ধারাবাহিকভাবে সঠিক ‘কল’ দিয়ে থাকেন, তাহলে তো আলাদাভাবে উল্লেখ করতেই হয়। তবে সব সময় তেমন হয় না আদৌ, বুঝতেই পারছেন।
স্পেকুলেশনের অন্য দৃষ্টান্ত দেখুন। আমি ক্রিপ্টোকারেন্সির কথা বলছি। কারেন্সি নয়, আর সরকারি সিলমোহর নেই তাতে। অবশ্য সে জন্য ক্রিপ্টো ট্রেডিং ‘এক্সচেঞ্জ’ গঠনে বাধা পড়েনি। এগুলির বিষয়ে সেবির কোনও রেগুলেশন নেই। কোনও নিয়ন্ত্রকের বিধিনিষেধ এখানে কাজ করে না। ক্রিপ্টোর দাম বাড়ায় কোনও সত্যিকারের কার্য-কারণ সম্পর্ক নেই। ইকুইটিতে, অতিমাত্রায় রিস্কি অ্যাসেট হওয়া সত্ত্বেও, কিন্তু কার্য-কারণ সম্পর্ক আছে। সংশ্লিষ্ট কোম্পানিটি একটি ‘এন্টারপ্রাইজ’ তো বটে, সেখানে আর্থিক পরিকল্পনার প্রতিফলন ঘটে সেটির ব্যবসার ক্ষেত্রে।
সব শেষে জানাচ্ছি, টাকা-পয়সার বিষয়ে সাবধান থাকুন। প্রশ্ন করুন, উত্তর খুঁজুন। নিজে সময় না দিতে পারলে, বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে দ্বিধা বোধ করবেন না।
(লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ ও ট্রেনার)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.