ইউলিপ শুধু জীবন বিমা নয়, লগ্নিরও আদর্শ ঠিকানা। গ্রাহকদের অনেকেই এই সত্য সম্বন্ধে বিস্মৃত। আর তাই সাধারণ মানুষের একটা বড় সংখ্যা এখনও এর অংশ নন, ফলে বলাই বাহুল্য-এর সুফলগুলি থেকেও বঞ্চিত। অথচ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে, সঠিকভাবে ব্যবহৃত হলে তরুণ প্রজন্মের কাছে এই প্রকল্প লাভজনক হতে পারে। বিশ্লেষণে দেবাশীষ নাথ
সঞ্চয় করা মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা। ভবিষ্যতের অজানা বিপদ-আপদ বা নিদেনপক্ষে হঠাৎ কোনও খারাপ সময় এলে, তার মোকাবিলা করার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বাস্তব রূপায়ণের স্বপ্ন নিয়েই মানুষ সঞ্চয়শীল হয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রবণতায়ও নানা রকমফের ঘটেছে। অতীতে মানুষের কাছে সঞ্চয়ের মানেই ছিল বর্তমানের রোজগার থেকে কিছু পরিমাণ অর্থ সরিয়ে রাখা। কিন্তু দ্রুত পরিবর্তনশীল বাণিজ্য জগৎ যত বেশি জটিল হয়েছে, অর্থনীতি যত বেশি বিনিময় মূল্য-মুদ্রাস্ফীতি-মন্দা প্রভৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে-মানুষের সাধারণ সঞ্চয়ের ভাবনায় তত বেশি প্রভাব পড়েছে।
মূলত ব্যাংকিং ব্যবস্থা সঞ্চিত অর্থকে বাড়িয়ে নেওয়ার প্রতি মানুষকে প্রলুব্ধ করেছে। ধীরে ধীরে সঞ্চয়কারী আকর্ষিত হয়েছেন স্বল্প সময়ে অধিক লাভের প্রতি। অর্থাৎ সঞ্চয়ের বেড়ে ওঠা যেমন জরুরি, স্বল্প সময়ে বেড়ে ওঠাও জরুরি। এই সুদ ও সঞ্চয়ের ভাবনার তুলনায় ‘বিমা’ অনেক পরের ভাবনা। সঞ্চয় ও তার উপর সুদ হয়তো অসময়ে মানুষকে সাহায্য করে কিংবা কোনও স্বপ্ন পূরণ করায় কিন্তু তা বৃহৎ পরিমাণে না হলে সঞ্চয়কারীর অবর্তমানে তাঁর পরিবারকে অর্থনৈতিক সঙ্কটমুক্তি বিশেষ দিতে পারে না। এখানেই জীবন বিমা চরিত্রগত ভাবে সঞ্চয় প্রকল্পের সাথে ভিন্নতর। কিন্তু সাধারণ মানুষ প্রথাগত বিমা প্রকল্পগুলিকেও সঞ্চয়ের মাধ্যম হিসেবেই বিবেচনা করে এসেছে।
ভাবনার এ গলদে কিন্তু রসদ জুগিয়েছে জীবন বিমা কোম্পানিগুলি এবং বিমা পরামর্শদাতারা। মেয়াদান্তে প্রাপ্য রাশির বিচারে চিরাচরিত বিমার পক্ষে এমনকি ব্যাঙ্কের প্রকল্পগুলির সঙ্গেও এঁটে ওঠা সম্ভবপর নয়। অন্যদিকে বিমা প্রকল্পগুলিকে আকর্ষক করে তোলার জন্য বিমা কোম্পানিগুলি সাধ্যমত বোনাস দেওয়ার চেষ্টা করে এবং তা করতে গিয়ে প্রিমিয়াম বাবদ প্রাপ্ত রাশি নানা জায়গায় লগ্নি করে মূলত ঋণ হিসেবে। স্বভাবতই নির্দিষ্ট পরিমাণ সুদ আদায় করে, মৃত্যুকালীন দাবি মিটিয়ে ও পরিচালন ব্যবস্থার খরচ বাদ দিয়ে উচ্চহারে বোনাস দেওয়া কোম্পানিগুলির পক্ষে সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। ঠিক এই রকম পরিস্থিতিতেই জন্ম নেয় ইউলিপ নামের প্রকল্প।
ইউলিপ অর্থাৎ ইউনিট লিঙ্কড ইনসিওরেন্স প্ল্যান। ভারতে ১৯৯১ সালে তৎকালীন ইউনিট ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া চালু করে ইউলিপ প্রকল্প। এই প্রকল্পের বিশেষত্ব এই যে, শুধুমাত্র মৃত্যুকালীন দাবি মেটানোর জন্য প্রিমিয়ামটুকু ও পরিচালন ব্যবস্থার খরচটুকু বাদ দিয়ে বিমাকারীর প্রিমিয়ামের বাকি টাকা বাজারে লগ্নি করা হয়। এর জন্য থাকে একটি বিশেষজ্ঞ দল। কোথায় এবং কোন অনুপাতে টাকা নানান সংস্থার শেয়ারে লগ্নি করলে বেড়ে ওঠার সম্ভাবনা বেশি, তা বিশ্লেষণ করে লগ্নি করা হয়। এক্ষেত্রে বাজারগত ঝুঁকি যেমন থাকে, তেমনি বোনাসের তুলনায় লাভের পরিমাণ অনেক বেশি হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে প্রচুর। সাধারণ মানুষ অতশত না বুঝেই সে সময়কার ইউটিআইয়ের ইউলিপ নিয়ে লাভবান হয়েছিল। কিন্তু বাজারের চরিত্র তো এক রকম থাকে না! তাই আমাদের দেশের জীবন বিমা কোম্পানিগুলি তাদের ইউলিপ প্রকল্পগুলিতে অনেক অনেক টাকা পাইয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা দেখিয়ে ভুল বিপণন করে এসেছে। ফলও ফলেছে হাতে নাতেই।
বেশির ভাগ প্রকল্পই মেয়াদান্তে বা মাঝপথে টাকা তুলে নেওয়ার ক্ষেত্রে বিমা গ্রাহকদের খুশী তো করতে পারেইনি বরং ইউলিপের প্রতি বিমুখ করে তুলেছে। ইউলিপ যে জীবন বিমার সঙ্গে সঙ্গে এক ধরণের লগ্নিও-এ কথা গ্রাহকদের বুঝিয়ে বলাও হয়নি। ফলে এ ধরনের প্রকল্প যে শেয়ার বাজারের ওঠা পড়ার সাথে জড়িত আর যখন তখন টাকা তুলে নিতে গেলে যে আকাঙ্খিত অর্থ না-ও পাওয়া যেতে পারে, তা বোঝানো হয় না। এর প্রতিফল এমনকি সরকারি জীবন বিমা সংস্থা, ভারতীয় জীবন বিমা নিগমকেও পেতে হয়েছে। সাধারণ মানুষ ইউলিপ প্রকল্পের ওপর বিশ্বাস হারিয়েছে এবং একটি আধুনিক সম্ভাবনাময় বিমা প্রকল্পের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। অথচ বর্তমান সচ্ছল প্রজন্মের মানসিকতার সাথে সাযুজ্য রেখে এ ধরনের প্রকল্প কিন্তু তুরুপের তাস হতে পারে।
বিমা কোম্পানিগুলির উচিত, এ নিয়ে নতুন ভাবে ভাবনা চিন্তা করা। আর মানুষের কাছে সম্ভাবনাময় লগ্নি-সহ জীবন বিমার এই নবতর প্রকল্পটিকে জনপ্রিয় করে তোলা।
(লেখক বিমা বিশেষজ্ঞ)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.