ঝুঁকি আছে, প্রতারণার শঙ্কা আছে, আছে দিকভ্রান্ত হওয়ারও অমোঘ হাতছানি। ক্ষেত্র যাই হোক, সুরক্ষা ছাড়া মাঠে নামলে যে কোনও সময় ঘটে যেতে পারে অঘটন। আর লগ্নির দুনিয়ায় সেই অঘটনের কবলে পড়লে, তার নাগপাশ ছাড়িয়ে ওঠা রীতিমতো কষ্টকর হতে পারে। তবে উদ্বেগের কারণ নেই। লিখছেন সোমকান্তি সরকার।
লগ্নিকারীর সুরক্ষা, বা ইনভেস্টর প্রোটেকশন, আজ একটি খুব প্রচলিত কথা, শব্দ বন্ধনীটি বেশ গালভরা শোনায়। এই সংক্রান্ত নিয়মকানুন নিয়ে অনেকেই খুব সচেতন, বিশেষত সংবাদ মাধ্যমে এটি আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠার কারণে। পুঁজির বাজার অর্থাৎ ক্যাপিটাল মার্কেট, নিয়ন্ত্রক সেবিও নানাভাবে সচেষ্ট, এ ব্যাপারে জনচেতনা বাড়ানোর জন্য। আইন মারফৎ, এবং কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতি ব্যবহার করে, বিনিয়োগকারীকে সুরক্ষা দিতে সরকারি চেষ্টার ত্রুটি নেই।
সাধারণ লগ্নিকারীর সুরক্ষা একান্তই প্রয়োজন, কারণটি বলাই বাহুল্য – মার্কেটে কান পাতলেই শুনবেন কিছু সংখ্যক মানুষ এবং প্রতিষ্ঠান অসৎভাবে, অসাধু উপায়ে ডিপোজিটর, শেয়ারহোল্ডার, বন্ড হোল্ডার এবং অন্যান্য বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করছে। একই সঙ্গে বলে রাখা ভাল যে বহু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে লগ্নিকারী নিজেই বেশি লাভের আশায়, সতর্কতা অবলম্বন করছেন না। অতি সাধারণ মানের ভুল-ভ্রান্তিও মার্কেটে বিরাট ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। লগ্নিকারী হিসাবে এ কথা মনে রাখা কর্তব্য। আরও ভুললে চলবে না, সঞ্চয়ের জগতের বহু জায়গায় ঝুঁকি আছে। ঝুঁকির কথা না ভেবে, বা জেনেও না বুঝে, অসাবধান হওয়া মারাত্মক অদূরদর্শিতার পরিচয় দেয়। খুঁটিয়ে দেখে, আগে ঝুঁকির ব্যাপারে জেনে নিয়ে, বিনিয়োগ করাই সমীচিন। অন্যথায় বিপদে পড়তে পারেন।
উদাহরণের অভাব নেই। প্রায়শই দেখি বিনিয়োগকারী সঞ্চিত অর্থ কার্পণ্য না করে মিউচুয়াল ফান্ডে ঢেলেছেন না বুঝেই (বলা ভাল অফার ডকুমেন্ট না পড়েই)। এমন নয় তিনি পড়ার সময় পান না, কিন্তু আদতে কখনওই করে উঠতে সক্ষম হন না। ফলে ভুল ফান্ড নির্বাচন, এবং অবশ্যই তীব্র দোষারোপ। মাঝে পড়ে সুরক্ষার নিয়মকানুনে ফাঁক না থাকা সত্ত্বেও সিস্টেম-এর বদনাম হয়ে যায়। এই জন্য আমি সকলকে বলি ‘ইন্টারমিডিয়ারি’ তথা মধ্যস্থতাকারী নির্বাচন যথাযথভাবে করতে। আপনার সার্ভিস প্রোভাইডার (এক্ষেত্রে ব্রোকার, মার্চেন্ট ব্যাঙ্কার, মিউচুয়াল ফান্ড ডিস্ট্রিবিউটর ইত্যাদি) যেন সুষ্ঠুভাবে, স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিষেবা দেন। জানি, ভাল (এবং ধারাবাহিকভাবে ভাল) পরিষেবা সকলের কপালে জোটে না-তাই এই খাতে সতর্কতার অত্যন্ত প্রয়োজন।
পরিষেবার কথাই যখন উঠল, তখন এই তালিকাটি পড়ে দেখুন। নিজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তৈরি করেছি।
১. সমস্ত আর্থিক ট্র্যানস্যাকশনের রসিদ তথা acknowledgement দরকার।
২. মিউচুয়াল ফান্ড বা ইনসিওরেন্স কোম্পানির কাছ থেকে স্টেটমেন্ট আপনার প্রাপ্য। তাই প্রয়োজনমতো নিয়ে নেবেন।
৩. স্টক ব্রোকার যদি অনৈতিক বা অসাধু কার্যকলাপ চালায়, অাপনার অজান্তে ট্রেড হয়ে থাকে, তাহলে তার প্রতিকার তো চাই-ই, আর তেমন কাজকর্ম যাতে না হয় তার জন্য প্রথম থেকেই সতর্ক থাকুন।
৪. সমস্ত রকম ফি, চার্জেস, ব্রোকারেজ, লোড ইত্যাদি নিয়ে অবগত থাকুন। আপনি নিশ্চয় জানেন ব্যাংক ইত্যাদি কি হারে ফি বাড়িয়েছে সাম্প্রতিক অতীতে। “কস্ট অফ ট্রানজ্যাকশন” নিয়ে আমার প্রথম লেখাটির কথা এইক্ষেত্রে মনে করুন।
এই তালিকা দীর্ঘতর হতে পারত, কিন্তু এখন যে আলোচনা না করলেই নয় তা সরকারি নীতি সংক্রান্ত। Investor Education & Protection Fund (IEPF)-এর কথাই ধরুন। সময়-সুযোগ বুঝে IEPF-এর ওয়েবসাইটটি খুলে দেখুন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস অনেক কিছু জানতে পারবেন। আমাদের দেশে বহু সংখ্যক বিনিয়োগকারী, বিশেষত ডিপোজিটর এবং শেয়ারহোল্ডার, ইতিমধ্যে উপকৃত হয়েছেন।
সাতটি নির্দিষ্ট স্তর পেরিয়ে আপনার IEPF-এ ট্রান্সফার হওয়া অর্থ ক্লেম করে নিতে পারবেন–
১. রেজিস্টার করুন ওয়েবসাইটে।
২. ফর্ম ভরুন (IEPF-5)।
৩. ডকুমেন্টের স্ক্যান করা কপি অ্যাটাচ করুন।
৪. রসিদ, ইনডেমনিটি বন্ড ইত্যাদির প্রিন্ট করতে পারেন।
৫. ওরিজিনাল ডকুমেন্ট পাঠানোর জন্য তৈরি থাকুন।
৬. সংশ্লিষ্ট কোম্পানি e-verify করবে ক্লেমটি।
৭. এরপর রিফান্ড পাওয়ার কথা।
এরপর বলি আরও একটি জরুরি কথা। সহজেই বিশ্বাস করে, চটজলদি বিনিয়োগ করে অনুশোচনা করবেন না। কোনও পেনশন ভিত্তিক ইনসিওরেন্স কেন কিনেছেন, সে কারণটি যেন স্পষ্ট হয়ে থাকে আপনার মনে। সঙ্গে সঙ্গে বুঝে নিন আপনি কেন টার্ম-প্ল্যান কেনেননি। আপনার বিমা পরামর্শদাতাকে জিজ্ঞাসা করতেই পারেন – সদুত্তর পাওয়া আপনার অধিকারের মধ্যে পড়ে। মিউচুয়াল ফান্ড কিনবেন? ভাল কথা, তবে কেন ওপেন-এন্ড ইকুইটি ফান্ড নেবেন, এবং সমসাময়িক ক্লোজ-এন্ড ফান্ডটি নেবেন না, তাও যেন জানা থাকে। এক্ষেত্রে মনে রাখুন, সমস্ত নতুন প্রোডাক্টেই যে মোক্ষলাভ, তা কিন্তু নয়। যথার্থ কারণ থাকলেই তেমন কিছু আপনি কিনুন, নতুবা এড়িয়ে যান।
সবশেষে বলি কিছু সাধারণ কিন্তু দরকারি সতর্কতার কথা–
১. কোনও ইস্যুয়ার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, কেবলমাত্র অলিখিত প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে বিনিয়োগ করবেন না।
২. ‘মার্কেট খুব তেজী, এবং এই তেজীভাব নিশ্চয় আরও অনেক দিন চলবে।’ এই ধরনের কথায় অসাবধান হয়ে পড়লে বিপদের সম্ভাবনা প্রবল।
৩. কেবল রেজিস্টার্ড ইন্টারমিডিয়ারির মাধ্যমে বিনিয়োগ করুন। সেবির বক্তব্য এ ব্যাপারে যথেষ্ট জোরালে।
৪. আপনার রিস্ক প্রোফাইলের সঙ্গে মেলে না, এমন বিনিয়োগ পরিত্যাজ্য।
৫. ব্রোকারের কনট্র্যাক্ট নোট পরীক্ষা করুন, নিজের করা ট্রেডগুলির সঙ্গে মেলান।
৬. ডিপোজিটরি পারটিসিপ্যান্ট দেওয়া হোল্ডিং স্টেটমেন্ট খুঁটিয়ে দেখুন।
৭. ডেলিভারি ইনস্ট্রাকশন স্লিপ প্রায় চেকবুকের সঙ্গে তুলনীয়, সেটিকে সুরক্ষিত রাখুন। তাতে ক্লায়েন্ট আইডি যথাযথভাবে স্ট্যাম্প করা আছে কি না দেখুন।
৮. সই করা স্লিপ, চেক, কাগজপত্র আগে থেকে দিয়ে রাখবেন না।
এই সাধারণ ব্যাপারগুলি না ভুলে, খোলা মনে মার্কেটে লেনদেন করুন। সাহস এবং ধৈর্য্য আপনার দুই প্রধান হাতিয়ার। সেই সঙ্গে অসাধু নীতির জালে পড়া থেকে বিরত থাকা আপনার পোর্টফোলিওটিকে জোরদার করবে।
(লেখক লগ্নি বিশেষজ্ঞ)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.