‘ইনসিওরেন্স ফর অল’ দূর অস্ত, অগণিত ভারতবাসী এখনও কোনও বিমা প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত নয়। ইনসিওরেন্স এমনই মহার্ঘ! অন্তত প্রাথমিকভাবে, নিচু হারের প্রিমিয়াম সংবলিত, প্রোডাক্ট দরকার। এবং এই উদ্দেশ্যকে রূপ দিতে প্রয়োজন সরকারি স্তরে ইতিবাচক নীতি। লিখছেন নীলাঞ্জন দে
বিমা নিয়ন্ত্রক ‘আইআরডিএ’ সম্প্রতি ‘কম্বিএমআই’ নামে এক প্রস্তাবের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে, একেবারে সাধারণ মানুষ এবং অতি-লঘু ব্যবসায়ীদের ইনসিওরেন্সের আওতায় নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে। ‘India@100 Insurance For All’ শীর্ষক প্রোগ্রামও চালু করার ব্যাপারে পদক্ষেপ করেছে কর্তৃপক্ষ। এই বিষয়ে খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে দেখা গেল, ‘ইনসিওরেন্স ফর অল’ দূরঅস্ত, অগণিত ভারতবাসী এখনও কোনও বিমা প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত নয়। কথাটা যে নিতান্ত জানা ছিল না তা নয়, তবে এই প্রসঙ্গে পুরনো কয়েকটা বিষয় ঝালিয়ে নেওয়ার সুযোগ হল। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অসাম্যেরর পরিপ্রেক্ষিতে, ব্যাংক-বিমা-পেনশন যে সবাই সমানভাবে পান না, তা আর নতুন করে বলার নয়। ‘হ্যাভ নট’ যারা, তারা বিভিন্ন ফিনানশিয়াল সার্ভিসেসের সুবিধা নিতে অক্ষম। ‘হ্যাভ’ শ্রেণি সে তুলনায় অনেক বেশি পরিষেবা পেয়ে থাকে। শুধু ভারতে কেন, পৃথিবী জুড়েই অর্থনৈতিক সাম্য অপ্রতুল, তা নিয়ে অনেক রাষ্ট্র বর্তমানে উদ্বিগ্ন। বিমার প্রসারিত ক্ষেত্রেও তা লক্ষণীয়, যদিও ইদানীং ইনসিওরেন্সের পরিধি বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। কয়েক দশক ধরে সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়াও হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
‘কম্বিএমআই’ (এখানে ‘এমআই’ হল মাইক্রো ইনসিওরেন্সের সংক্ষিপ্ত রূপ) বা এই ধরনের বিমা প্রকল্পের মাধ্যমে প্রত্যন্ত মানুষকে সুযোগ দেওয়া যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি। তবে তার আগে কিছু শর্ত পূরণ হওয়া দরকার। আমি ‘পলিটিক্যাল উইল’ বা রাজনৈতিক সদিচ্ছা, তথা সিদ্ধান্তের কথা বলছি না, ওই প্রসঙ্গ ইচ্ছা করেই আর উত্থাপন করলাম না। স্রেফ বলতে চাই, অর্থনীতি তথা বিমা ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে জড়িত কিছু কথা।
প্রথম বিষয়, প্রিমিয়াম। বস্তুত, প্রিমিয়ামের পরিমাণ স্বল্প না হলে, সাধারণ মানুষ বিমার ব্যাপারে আগ্রহী হবে কেন? নিঃসংকোচে তারা কোন ভরসায় এগিয়ে যাবে?
সাধ এবং সাধ্যের ফারাক তো থাকবেই, আর এ যুগের প্রিমিয়াম বৃদ্ধি তো খবরের শিরোনামে কবেই এসে গিয়েছে। ইনসিওরেন্স এমনই মহার্ঘ হয়ে উঠছে। কাজেই দরকার, অন্তত প্রাথমিকভাবে, নিচু হারের প্রিমিয়াম সংবলিত প্রোডাক্ট। এবং এই উদ্দেশ্যকে রূপ দিতে, স্থায়িত্ব দিতে, প্রয়োজন সরকারি স্তরে ইতিবাচক নীতি। এই প্রসঙ্গে জেনে রাখা ভাল যে, বিমা নিয়ন্ত্রক মাইক্রো ইনসিওরেন্স রেগুলেশন্স আগেই এনেছে বিভিন্ন ‘লো-ইনকাম ক্যাটেগরি’ শ্রেণির গ্রাহকদের জন্য। বয়স্ক নাগরিক বা কৃষিজীবীদের কথা আলাদাভাবে বলা যায়। বিশেষ গ্রুপের জন্য বিমা প্রোডাক্ট নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কাজেই প্রকল্পের সংখ্যা যে কম, তা বলা উচিত হবে না। যা বলা অবশ্যই দরকার, না বললেই নয়, তা হল বিমা প্রকল্পের মূল খামতি- কভারেজ এখনও এক সীমিত চৌহদ্দির মধে্য। গণ্ডি বাড়িয়ে তাই অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ যাতে বিমা পরিষেবা পায়, নাগরিকদের স্বার্থে তা দেখতে হবে দেশের সরকারকেই। এর জন্য চাই কিছু আইনি ব্যবস্থা এবং নতুন কয়েকটি পদ্ধতির প্রয়োগ। পদ্ধতির কথাই যদি উঠল, তাহলে বলি, নতুন শ্রেণির ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেল তৈরি করা দরকার। চালু চ্যানেল, যা ইতিপূর্বেই পরীক্ষিত, শক্তপোক্ত করারও প্রয়োজন হবে। না হলে কীভাবে নয়া ইনসিওরেন্স প্রোডাক্ট গ্রাহকের হাতে পৌঁছবে? সরকারের হাতে তো কোনও জাদুদণ্ড নেই, যে, একলহমায় সব হবে।
দুঃখের বিষয়, ‘ডিস্ট্রিবিউশন কস্ট’, অর্থাৎ ফিনানশিয়াল প্রোডাক্ট বিক্রির অন্যতম প্রধান খরচ যার জন্য করা হয়, খানিকটা হলেও রহস্যে ভরা। একটু বিশদে বলি। আপনি কি বিশেষ করে আপনার ব্রোকার, ডিস্ট্রিবিউটর বা এজেন্টকে জিজ্ঞাসা করেন, আচ্ছা, এই যে প্রোডাক্ট আমি কিনলাম, এখানে ডিস্ট্রিবিউশন কস্ট কত?
সাধারণভাবে কেউ-ই তা করে না। তবে সব তথ্য স্বচ্ছভাবে বলা থাকে। ইনসিওরেন্স সংস্থা বলুন বা স্টক ব্রোকিং ফার্ম, প্রতে্যকে সবকিছু নিয়মমাফিক জানিয়ে রাখে। বিভিন্ন রেগুলেটর (IRDA ছাড়াও আছে SEBI এবং PFRDA) এসব নিয়ে যথেষ্ট সজাগ- এই কথা বেশ জোর গলায় বলা যায়। এত কিছু সত্ত্বেও আমরা চটজলদি এই সমস্ত বিষয়ে ঢুকতে অনিচ্ছুক। যাই হোক, আমার বক্তব্য হল, ডিস্ট্রিবিউশন-জনিত খরচ যথাসম্ভব কম রাখা দরকার। অতএব পুরনো ধাঁচের কমিশন-ভিত্তিক ডিস্ট্রিবিউশন এখানে চলবে না, বেমানানও ঠেকবে। লো-কস্ট ইনসিওরেন্সের প্রতিশ্রুতি রাখা দুষ্কর হবে, যদি বিক্রির খরচ নূ্যনতম না হয়। তাই সাধারণ চলতি পদ্ধতি অবলম্বন করে লোকের কাছে পৌঁছনো যাবে না।
তাহলে উপায়? ব্যাংক-পোস্ট অফিসের নেটওয়ার্ক তো ব্যবহার করা হয়েই গিয়েছে, বাকি আছে অন্যান্য জনসংযোগের রাস্তা এবং সেই সংক্রান্ত প্রচার। সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে এগিয়ে যাওয়া যায় কীভাবে, তা-ও বাজিয়ে দেখা দরকার। কোন উপায় সম্বল করে একেবারে গ্রাস রুট পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব, তা নিয়ে নতুন ভাবনাচিন্তার সময় এসেছে। গ্রামীণ বা আধা-শহুরে অর্থনীতির সঙ্গে একান্তভাবে জড়িত ফরমুলা ব্যবহার করা কি উচিত? প্রতিটি নতুন সিম কার্ডের গ্রাহককে কি বিমার আওতায় আনা যাবে? অথবা নতুন কেনা সাইকেলের মালিককে? চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।
আইনি পরিবর্তন সোজা বিষয় নয়, তবে মাইক্রো তথা অন্য ইনসিওরেন্সকে আবশ্যিক করার কথা (নতুন আইনের মাধ্যমে) কি কেউ ভেবে দেখেছে? ভবিষ্যতের ভারতের সম্ভাব্য চিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন, আবশি্যকতার প্রয়োজন ঠিক কতখানি, তা উপলব্ধি করবেন। মনে রাখুন, আরও কয়েক বছরে আমরা চিনকে ছাপিয়ে যাব জনসংখ্যার নিরিখে। ভারতে প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা বাড়ছে।
ভবিষ্যতে এরা বহুলাংশে সন্তান বা পরিবারের উপর আর্থিকভাবে নির্ভরশীল হবে। সামাজিক কাঠামো বদলে যাওয়ায় ইতিমধ্যে পরিবারে ভাঙন ধরেছে, তা ছোট হচ্ছে, আর মানুষ দেশান্তরী না হোক অন্য শহরে যাচ্ছে কাজের সন্ধানে। ওল্ড-এজ সিকিউরিটির অভাব বেশ প্রকট, ঠিক তেমনই প্রকট লো-কস্ট তথা লো-এন্ড বিমার উপযোগিতা। প্রান্তিক মানুষের জন্য, বয়স-লিঙ্গ নির্বিশেষে, এই শেষোক্ত পরিষেবার একান্ত প্রয়োজন।
‘ইউনিভার্সাল ইনসিওরেন্স’- কান পাতলে এই কথা সহজেই শুনতে পারবেন। যে কোনও ডেভলপিং নেশনের উদ্দেশ্য থাকে, ফিনানশিয়াল সার্ভিসেস সহজলভ্য করা, আম আদমির হাতের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসা। ইনক্লুশনের যুগে এই নিয়ে নীতিগত অবস্থান নিয়েছে সরকার। ইনসিওরেন্স সংস্থাও বিভিন্ন সময়ে নানা প্রকল্প এনেছে। ‘এলআইসি’-র নাম প্রথমেই মনে পড়ে এই প্রসঙ্গে। প্রোডাক্টের উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে, ‘মাইক্রো বচত প্ল্যান’। নানাবিধ সেল্ফ-হেল্প গ্রুপ এবং নন-গভর্নমেন্ট অর্গানাইজেশনের মদতে এই জাতীয় প্ল্যান নিয়ে গ্রাহকের কাছে যাওয়া হয়। মাইক্রোফিন্যান্স সংস্থাও এইসব ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়। এলআইসি তো একটি কোম্পানি, অন্যান্য প্রাইভেট সংস্থাও তো আছে এদেশে। যতক্ষণ না সমগ্র বিমা ইন্ডাস্ট্রি দূর-দূরান্তরে না যেতে পারছে, ততক্ষণ ইউনিভার্সাল ইনসিওরেন্স অধরা। সরকারি নীতি সহায়ক হতে পারে মাত্র, তার সার্থক রূপায়ণ না হলে বিমা ক্ষেত্র একপেশে রয়ে যাবে- ‘ক্লাস’ থেকে ‘মাস’ যাতে দ্রুত হতে পারে, সে বিষয়ে সচেষ্ট হতে হবে পলিসি মেকারদের।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.